ভোক্তার আয় বাড়েনি কমেছে ক্রয়ক্ষমতা

করোনার নেতিবাচক প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। করোনার পর এখনও পরিস্থিতি পুরো স্বাভাবিক হয়নি। অনেকে কম বেতনে চাকরি করছেন। অনেকে আবার কর্ম হারিয়ে বেকার হয়েছেন।

নিয়োগ কম থাকায় চাকরিতে ঢুকতে পারছেন না শিক্ষিত বেকাররা। সব মিলিয়ে আয় কমেছে বেশিরভাগ মানুষের। অন্যদিকে করোনার পর হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। গত পাঁচ মাসের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়েছে। এতে ভোক্তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় থাকছে না।

বাধ্য হয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করছেন। কমিয়ে দিয়েছেন দৈনন্দিন খরচ। এতে ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন।

নতুন সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ভোক্তার আয় কমায় ও দ্রব্যমূল্য বাড়ায় ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় হাঁসফাঁস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

মানুষের জীবনযাত্রার ব্যবহার্য সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। পাশাপাশি পরিবহণ, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষাখাতে ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া পোশাক কেনা, টেইলার্সে সেলাই, জুতা, জুতা সেলাই ও পলিশ, সেলুনে চুল কাটাসহ সব ক্ষেত্রেই খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তরা। দীর্ঘশ্বাস বেড়েই চলছে তাদের।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মানুষের আয় বেড়েছে। কিন্তু তাদের হিসাবেই আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে বেশি। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর বিপরীতে মানুষের আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিবিএস আয়ের হিসাব বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। আবার মূল্যস্ফীতির হিসাব কমিয়ে দেখাচ্ছে। অনেকের হিসাবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার বিবিএস যা দেখাচ্ছে তার দ্বিগুণ। অর্থাৎ ১২ শতাংশের বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে চাল, ডাল, আটা, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, সবজি সবকিছুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ওই হারে বিবিএসের হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার বাড়েনি।

সূত্র জানায়, বিবিএস ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে এখনও মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করে। ওই সময়ে ১০০ টাকা খরচ যে খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত তা কিনতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ৩৪০ টাকা ২৫ পয়সা।

অর্থাৎ তাদের হিসাবে ওই সময়ে দাম বেড়েছে তিনগুণ। এই তথ্যকে সঠিক মনে করছেন না অনেকেই। বাজারের চিত্র ভিন্ন। দ্রব্যমূল্য আরও বেশি বেড়েছে।

আলোচ্য সময়ে ১০০ টাকার কাপড়ের দাম বেড়ে হয়েছে ৩২৮ টাকা ১৮ পয়সা। একইভাবে ১০০ টাকার বাড়ি ভাড়া এখন বেড়ে হয়েছে ২৩৪ টাকা ৬৫ পয়সা। গৃহসামগ্রী ৩২৫ টাকা ৯৩ পয়সা, চিৎকিসা ব্যয় ২৫৪ টাকা ৫৯ পয়সা, পরিবহণ ব্যয় ৩১৯ টাকা ৮২ পয়সা, বিনোদনে ২০৬ টাকা ৫৯ পয়সা খরচ হচ্ছে।

বিবিধ সেবা খাতে ১০০ টাকার ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৩২০ টাকা। বাস্তবে এসব খাতে ব্যয়ের হার আরও বেশি বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১০-১১ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে মজুরি বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করে। ওই বছরে ১০০ টাকার মজুরি এখন বেড়ে হয়েছে ১৯৬ টাকা ০৪ পয়সা। কৃষি খাতে যে শ্রমিক ১০০ টাকা আয় করতেন তারা এখন ১৯৬ টাকা ৪৬ পয়সা আয় করেন।

শিল্প খাতের শ্রমিকদের আয় ১০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯২ টাকা ১২ পয়সা। সেবা খাতে ২০২ টাকা ০৪ পয়সা হয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে বেশি। এদিকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের এক-তৃতীয়াংশ কাজে ফিরতে পেরেছেন।

এর মধ্যে ৭২ শতাংশ আগের বেতনেই ফিরেছেন। নয় শতাংশের বেতন কমে গেছে। বাকিরা চাকরিতে ফিরতে পারেননি। কর্মহীনতার কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। এছাড়া শুধু পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছেন। এতে পুষ্টিহীনতা বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সে তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে।

এতে প্রথমে কাটছাঁট করা হচ্ছে বিনোদন ও ভ্রমণ খরচ। তারপরে খাদ্যের অনেক খরচ। তারপরে চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচ। অনেকে বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় উঠছেন। এভাবে সমন্বয় করছেন। এভাবে চরতে থাকলে শিক্ষার মানে ধস নামবে। খাদ্য কম গ্রহণ করার ফলে পুষ্টিহীনতা বাড়বে।

এদিকে মঙ্গলবার রাজধানীর, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার, নয়াবাজার ও মালিবাগ বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে-প্রতিবছর কিছু না কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে। যা পরে আর কমছে না।

তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর সব ধরনের পণ্য অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। এই বাড়ার তালিকায়-চাল থেকে শুরু করে ডাল, আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, মসলা জাতীয় পণ্য, মাছ-মাংস, ডিম রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে মূল্য বৃদ্ধির ব্যবধান দীর্ঘ হচ্ছে।

গত এক বছরের ব্যবধানে রিকশা, সিএনজি ও বাস ভাড়া দ্বিগুণ বেড়েছে। যেখানে গত বছর সেলুনে চুল কাটাতে সর্বনিম্ন ৬০ টাকা খরচ হতো, বর্তমানে ১০০ টাকা লাগছে। গত বছর ১০ টাকায় জুতা সেলাই ও ২৫ টাকায় পলিশ করা গেলেও এখন ১৫ ও ৩৫ টাকা লাগছে।

যেখানে গত বছর একটি প্যান্ট সেলাই করতে টেইলার্সে ৫০০-৭০০ টাকা দিতে হতো, এখন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দিতে হচ্ছে।

এছাড়া ভোজ্যতেল ও গমের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের বেকারি পণ্যের মূল্য বেড়েছে। মাঝারি আকারের একটি পাউরুটি ২৫ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৩৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। দুই পিসের প্যাকেট ড্রাইকেক ১০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ১৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

পাড়া বা মহল্লার রাস্তার পাশের হোটেলে প্রতি পিস পরোটা ১০-১৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিল ৫-১০ টাকা। ছোট সাইজের এনার্জি বিস্কুটের দাম ৩০ টাকা, যা আগে ছিল ২০ টাকা। মাঝারি চানাচুরের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা, যা আগে ৩৫ টাকা ছিল।

নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মধ্যে ৩০ টাকার লাইফবয় সাবান এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৮৫ টাকার এক কেজি হুইল পাউডারের দাম এখন ১০০ টাকা। ১০০ টাকার পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট এখন ১২০ টাকা। ৪০০ এমএলের অ্যারোসল ৪৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ৪০০ টাকা ছিল।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে এই মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় থাকা পণ্যের দামের ব্যবধান আরও বাড়ছে।

বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। সঙ্গে সেই পণ্য আনতে পরিবহণ ব্যয় ও ডলারের দাম বাড়ায় পণ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বিশ্ববাজার পরিস্থিতির অজুহাতে কারসাজিতে লিপ্ত হয়েছে।

তারা অতি মুনাফা করতে পণ্য মজুত করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। যা কোনোমতেই ঠিক নয়। সে বিষয়ে তদারকি সংস্থাগুলোর দেখভাল করতে হবে। অনিয়ম পেলে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।

মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল বিক্রেতা মো. দীদার হোসেন বলেন, আমার ব্যবসায়ী জীবনে দেখিনি কখনও ভরা বোরো মৌসুমে চালের দাম বেড়েছে। এবার এই চিত্র দেখতে হলো। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি কেজি চাল ৫-৬ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।

মঙ্গলবার প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬৮ টাকা। যা গত বছর একই সময় ৬২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকা। যা গত বছর একই সময় ৪৪-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, গত বছর একই সময় প্রতি কেজি খোলা আটা ৩২ ও প্যাকেটজাত আটা ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছি। যা এখন ৪৮ ও ৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রতি কেজি খোলা ময়দা ৬৫ ও প্যাকেটজাত ময়দা ৭০ টাকায় বিক্রি করছি। যা গত বছর একই সময় ৩৬ ও ৪৫ টাকা ছিল। এছাড়া বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ ও বোতলজাত ২০০ টাকা।

যা এক বছর আগে ছিল ১২৬ ও ১৫০ টাকা। প্রতি কেজি ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা। যা আগে ১১০ টাকা ছিল। বছরের ব্যবধানে মাঝারি আকারের মসুর ডাল কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে ১২৫-১৩০ টাকা হয়েছে। আর কেজিতে ৪৫ টাকা বেড়ে বড় দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা।

তিনি জানান, বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৭০ টাকা বেড়ে আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে দেশি হলুদ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা। ২০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি আমদানি করা আদা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা।

৭৫ টাকার চিনি এখন বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৫ টাকা। পাশাপাশি প্রতি হালি ফার্মের ডিম এখন ৪৪-৪৫ টাকা। এক বছর আগে ছিল ৩০ টাকা। শিশু খাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ প্রতি কেজি ডানো বিক্রি হচ্ছে ৭১০ টাকা। যা এক বছর আগে ৬৪০ টাকা ছিল।

এদিকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১২০ টাকা। গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি। আগে ছিল ৬০০ টাকা।

বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু এই বাড়ার সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীরা কিছু পণ্যের দাম নিজের মতো করে বাড়িয়েছে।

কিছু অনিয়ম আমাদের কাছে ধরা পড়ছে। তাই বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা তদারকি অব্যাহত রেখেছেন। অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। (যুগান্তর)

Share