ব্যস্ততম সড়কের সঙ্গে লাগোয়া চট্রগ্রাম আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মূল ফটকের হুকটা আলতো করে লাগানো আছে বটে, কিন্তু পাশের ছোট্ট জায়গা দিয়ে যে কেউ ঢুকে যেতে পারবে নিশ্চিন্তে। সে রোগী হোক কিংবা কোনো দুর্বৃত্ত। বাধা দেবে কে? নিরাপত্তা রক্ষীই যে নেই সেখানে।
ঘড়ির কাঁটা যখন বুধবার দিনগত রাত সাড়ে ১২টার ঘরে ছুঁটছে সেই ফটক পেরিয়ে পা চলছে সামনে। দশ হাত মতো এগুতেই একটি বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে খেলছে কুকুরের দল? অপরিচিত আগন্তুক দেখেই ফ্যাল ফ্যাল চাহনি, হাঁকডাকও মারতে চায়। ওরাই যেনো অঘোষিতভাবে হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বটা পালন করে চলেছে।
এই পথের পরেই অন্ধকার রাজত্ব শুরু। পুরোটা পথ প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার মাড়িয়েই হাসপাতালের মূল ভবনগুলোতে যেতে হবে। চারপাশটা নিস্তব্দ। পথ চলতে চলতে যে কারো মনে হবে কি হাসপাতাল ভুলে কোনো ভুতুড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ি নি তো?
মেডিসিন বিভাগে কথা হলো কর্তৃব্যরত চিকিৎসক আসাদের সঙ্গে। পর্যাপ্ত আলো নেই, নেই নিরাপত্তা রক্ষীও। এই ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে রাতে নিরাপত্তার অভাববোধ করেন না?
এমন প্রশ্নে তিনি বেশ আশাবাদী বক্তব্য দিলেন। ‘আমরা চিকিৎসক। মানুষের সেবা করাই আমাদের কাজ। মানুষ আমাদের দেবদূত মনে করে। তাই নিজেদের ইনসিকিউরড ফিল করি না। কারণ জানি, কারো ক্ষতি না করলে কেউ আমাদের ওপর আঘাত করবে না।’
ডা. আসাদের কাছে হয়তো দেবদূত পরিচয়টাই ভরসা। কিন্তু রোগী কিংবা রোগীর স্বজনদের কাছে?
সরেজমিনে সার্জারি বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ড কক্ষগুলো খোলা। সেখানে প্রচুর রোগী ভর্তি আছেন । নার্সরা বন্দি তাদের নিজস্ব কক্ষে। বাইরে টুলের উপর শুয়ে আছেন ওয়ার্ড বয় শহীদ।
কথা হয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। ‘ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই। ঘুমাবেন না?’ এমন প্রশ্নে কিছুটা যেনো আশ্চার্যই হলেন তিনি।
তিনি বলেন, তিনদিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে এখানে এসেছি। পকেটে চিকিৎসার জন্য আনা টাকা পয়সা আছে, সঙ্গে রোগীর গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। হাসপাতালে কোনো নিরাপত্তা রক্ষী নেই, নেই পর্যাপ্ত আলোও। এমন পরিস্থিতিতে ঘুমানোর কথা চিন্তা করি কিভাবে?
ওয়ার্ডের দেওয়ালে সাঁটানো চার লাইনের একটি সতর্কবার্তা আরও স্পষ্ট করল নিরাপত্তা সংকটের কথা। ‘প্রতারক থেকে সাবধান’ শিরোনামে লেখা সেই সতর্কবার্তাটি এমন, ‘ইদানিং কিছু প্রতারক রোগীদের পরিচিতি কিংবা আত্মীয়ের অভিনয় করে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব ভদ্রবেশী প্রতারকদের সঙ্গে কোনো প্রকার কথাবার্তা কিংবা লেনদেন করবেন না।’
এমন সময় কথা হয় ওয়ার্ডের দায়িত্বপালনকারী নার্স উষা দাশের সঙ্গে। তার কণ্ঠেও নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ উদ্বেগ সহকারে শোনা গেল।
‘ভেতরে হয়তো আমরা আছি, ওয়ার্ড বয় আছে। কিন্তু বাইরে তেমন নিরাপত্তা সেভাবে নেই।’-জবাব উশা দাশের।
এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগটাতো আরও বলতে গেলে রাস্তার উপরই। সেখানে বুধবার দিনগত রাতে দায়িত্বে পালন করছিলেন ডা. ডেইজি বড়ুয়া। তার সঙ্গে একজন ব্রাদার ও একজন কর্মচারী। এই তিনজন মানুষ আর বুধবার রাত ১০টা অব্দি ভর্তি হওয়া ৩৫জন রোগী। জরুরি বিভাগ বলে সার্বক্ষণিক খোলা রাখতে হয় ফটক।কিন্তু এই ৩৮ জন মানুষ রাত কাটাচ্ছেন নিরাপত্তা সংকটের ওপরই।
তাই ডা. ডেইজি বড়ুয়ার বক্তব্য, ‘ভয় তো লাগে। আরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।’পুরো হাসপাতাল ঘুরে কথা বলা প্রায় সব চিকিৎসক, রোগী আর তাদের স্বজনদের বক্তব্যে উঠে এসেছে নিরাপত্তা সংকটের কথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিসক বলেন, আমরা (চিকিৎসক), রোগী ও রোগীর স্বজনদের নিরাপত্তা নেই তা তো পরিস্কার। পাশাপাশি এই হাসপাতালে রয়েছে অনেক দামি দামি চিকিৎসা যন্ত্র। এসব যন্ত্রাদিও তো পড়ে আছে ঝুঁকির মধ্যে।
এই চিকিৎসক মনে করেন, ‘সার্বক্ষণিক রোগীতে ভরাট থাকা এই হাসপাতালে রাতের বেলা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা উচিত। একটা নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সার্বক্ষণিক রাখা কেবল উদ্যোগের ব্যাপার। পাশাপাশি পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করাও তো তেমন টাকার প্রয়োজন নেই।’
তাই রোগীর চিকিৎসা সেবা পরিচয়ের চেয়ে ভুতুড়ে পরিবেশ, নিরাপত্তা সংকট- শব্দগুলোই প্রতি রাতে ভেসে আসে ২৫০ শয্য বিশিষ্ট এই হাসপাতালের চিকিৎসক আর রোগীর কণ্ঠে। (বাংলানিউজ)
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ২:২০ পিএম, ৩ নভেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur