প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। সাতগ্রামে যুদ্ধ বাধিয়ে পরিবানকে যখন ঘরে আনে প্রবাসী নরিন শেখ তখন ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল নাকি, এমন সুন্দরী বউ ঘরে রাখা দায়। তা হলে বলতে হয়, পৃথিবীর সমস্ত সুন্দরীকে এরিয়ে যাওয়া ভাল? মানুষ সবকিছু করতে পারে তবে কিছু আদত বদলাতে পারে না। কারও ক্ষতি করতে পারল না কমপক্ষে হিংসা হলেও করবে। মানুষের এ এক অদ্ভুত স্বভাব!
আমরা নরিন শেখকে যতটুকু চিনি পরিবানকে ততটুকু চিনি না। শোনেছি, সাতগ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। শিক্ষাদীক্ষায় উচ্চডিগ্রি হাসিল করতে না পারলেও সুন্দরীর বড় ডিগ্রি সহজেই হাসিল করে নিয়েছিল ‘অতুলনীয়া’। আরও শোনছি, এ অতুলনীয়াকে একনজর দেখার উদ্দেশ্যে নাকি সাতগ্রামের যুবকেরা দলবেধেঁ তার প্রতিদিনের চলার পথে দাঁড়িয়ে থাকত। অনেকের স্বপ্নরানি হঠাৎ এভাবে কারও ঘরণী হবে কল্পনা করেনি কেউ। বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হলে ওসব মতলবিদের প্ররোচনায় কিছু বদমহিলা জোটে তাকে কুসলা দিতে। সকল কুমন্ত্রণা উপেক্ষা করে নাকি পরিবান নরিন শেখের স্ত্রী বনে। চক্রান্তকারীরা বিয়ের দিন যে অভিনব এক ব্যর্থহাঙ্গামার চেষ্টা চালিয়েছিল সেটা এখনো মধ্যে মধ্যে আলাপপ্রসঙ্গে শোনা যায়। এপর্যন্ত আমরা তার এটুকু তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছি।
এক দরিদ্র কৃষকপরিবারে জন্ম নিয়েছিল নরিন শেখ। তখন বিদেশসম্বন্ধে অনেকেরই অজ্ঞতার কথা আমরা জানি। বিদেশ গিয়ে টাকা উপার্জন করে ধনী হওয়া যায়, এ কথাটা আমাদের অনেকেরই জানা থাকলেও তবে কিভাবে কোথায় যাওয়া যায় সেটা আমাদের অনেকের জানা ছিল না। তাই নরিন শেখের বিদেশগমন শুধু ভাগ্যই নয় একেবারে ব্যতিক্রমই বলা যায়।
অভাবিসংসারের হাল টানতে টানতে নরিনের মতো যারা ক্লান্ত নয় তাদের বাস্তবতা কখনো-না-কখনো রূপান্তরিত হবে গল্পে। তাদের সম্পদ বলতে সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া বিঘাদুয়েক বর্গাজমিই ছিল একমাত্র অবলম্বন। স্বস্তির নিঃশ্বাস কী নরিনদের সংসারে সেটা অনুভব করার মতো তখন অবকাশই ছিল না। তাই নরিন কখনো কখনো জীবনের প্রতি বিরক্ত বোধ করে সৃষ্টিকর্তার উপর অভিমান করে বলত ঠিকই, প্রভু, সৃষ্টির প্রতি যখন এতই বিমুখ হবে, তবে সৃষ্টি না করাটাই কি ভাল ছিল না? কিন্তু স্রষ্টার উপর অত্যন্তিক বিশ্বাস এবং ভরসাও রাখত। তাই বোধহয় তার উন্নতির সিঁড়িতে কখনো ঘুণপোকায় আক্রমণ করতে পারেনি। আল্লাহ্কে যারা মানে ও ভালবাসে এবং আল্লাহ্ আছে বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে দেখা যাচ্ছে তারাই পৃথিবীতে সব সময় সফল হয়েছে। কিন্তু, কিছু কিছু ভুল মানুষকে ধুলায় পতিত না করলেও আকাশেও স্থান রাখেনি দেখা যায়।
এখান থেকে তবে নরিনের শুদ্ধ জীবন শুরু। একদিন ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই করে জমিতে হাল দিতে গিয়ে যখন বলদের পা কেটে ফেলে তখন বাবার ভয়ে পালিয়ে আসে শহরে। এখানে এক বন্ধুর খোঁজে দুয়েকদিন ঘুরাঘুরির পর তার সঙ্গে কুলির কাজে যুক্ত হয় বন্দরে। বেশ কিছু দিন কেটে গেলে একদিন ব্রিটিশ এক জাহাজে বোঝা নিয়ে উঠে সুযোগ বুঝে আর নামেনি। জাহাজটা সাউদহ্যাম্পটন বন্দরে এসে ভিড়লে ভদ্র এক ইংরেজদম্পতির নজরে পড়ে সহানুভূতি পায়। ইংরেজ টুকটাক বাংলা বলতে পারত। ভদ্রলোক নাবিককে তাঁর চাকরপরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে সঙ্গে।
নরিন ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছে তার মায়ের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় থাকে লন্ডন। ভদ্রলোক যেমন ধনের মালিক তেমন মনের মালিকও শোনেছে। ইংরেজ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে জানায় ওই আত্মীয়ের কথা। নাম সুহান হৃদ্দার। হৃদ্দার হোসেনের ছেলে। বাড়ি ঝিঙেতলা। এটুকু মাত্র জানা। ইংরেজদম্পতি তাকে একটা হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। পরদিন ভদ্রলোককে পুলিশের সঙ্গে আসতে দেখে নরিনের কণ্ঠ শুকে কাঠ। ভদ্রলোক নরিনকে ডেকে পুলিশের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, যতক্ষণ তোমার অই আত্মীয়কে খুঁজে পাওয়া গেল না ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি এ অফিসারের দায়িত্বে থাকবে। নরিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে পেল। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে একটা কার্ড দিয়ে বললেন, অফিসার, প্রতিদিন আমাকে খবরাখবর জানাবেন। মানুষটি অসহায়, এখানে ঈশ্বর ছাড়া তার আর কেউ নেই। ঈশ্বরের পরে অই আত্মীয়ই একমাত্র ভরসা। অনুরোধ করে বললেন, তাকে খুঁজে দেওয়াতে যেন অবহেলা না হয়। হোটেলের সমস্ত বিল আমি পরিশোধ করব। মানুষেতেই শয়তানের রূপ এবং মানুষেতেই ঈশ্বরের রূপ। নরিনের জন্যে এ ভদ্রলোকই ত ঈশ্বর।
পুলিশ ভদ্রলোকও দায়িত্বে এতটুকু অবহেলা করেনি। প্রতিদিন নরিনকে নিয়ে ডিউটি করতে লাগল। আজ এই শহরে ত কাল ওই শহরে। এভাবে কয়দিন খোঁজাখুঁজির পর অনেক সুহানের দেখা মিলে, তবে সুহান হৃদ্দার নামে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় পনের দিন পর ব্র্যাডফোর্ড শহরে সুহান হৃদ্দারের হদিশ মিলে। ভদ্রলোক নরিনকে স্বপ্নেও দেখেনি কোনদিন, নরিনও তাঁকে দেখেননি কোনদিন; কিন্তু পুরো পরিচয় দেওয়ার পর সুহান নরিনকে সহজেই চিনতে পারে। তার পর নরিনকে আর পিছে ফিরে দেখতে হয়নি ঠিক কিন্তু এ তিন ঈশ্বরকে বারবার পিছে ফিরে দেখেছে। একজন মানুষের এমনই গুণ হওয়া দরকার।
এদিকে নরিনের নিরুদ্দেশের খবর শোনে মায়ের অবস্থা ঘোরতর–কান্নায় একেবারে হুঁশহারা। বাবা যদিওবা মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তবে মনের কাঁদনে ভিতরে ভিতরে তিনিও প্লাবিত। তখনকার পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবীর মধ্যে যেমন অনেক তফাৎ হয়ে গেছে তদ্রূপ তখনকার বিদেশ আর এখনকার বিদেশের মধ্যে অনেক নয় আকাশপাতাল ব্যবধান হয়ে গেছে। বর্তমানের পৃথিবী যতই সহজ মনে হচ্ছে কিন্তু বর্তমানবিশ্বের মানুষ ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে!
বিয়ের পর স্বামীর ভালবাসার পাত্রী একমাত্র স্ত্রী এবং স্ত্রীর ভালবাসার পাত্র একমাত্র স্বামী। তাই নরিনকে আমরা প্রবাসী বলে দোষ দিতে পারি না। কারণ বিয়ের পর থেকে দেখা গেছে তিন-চার মাসান্তর সে বাড়ি ফিরছে। তা হলে দীর্ঘাবস্থিত প্রবাসীর মতো তাকে আমরা অবহেলার দায় চাপাতে পারি? তবে হাঁ, পরিবানের কিছু অলসতা আমরা লক্ষ্য করব; তন্মধ্যে প্রধান, ঘরের বার-তেরটা কক্ষের মধ্যে সচরাচর সদর দরজা ছাড়া কোনো একটা কক্ষে খিল দিতে দেখি না তাকে। এমনকি নিজের কক্ষেও না! এটাকে তার ভুল বলব, না বদভ্যাস, না বোকামির কোন লক্ষণ–আমাদের বুদ্ধিতে আসে না। স্বামীর বর্তমান হলে একথা উত্থাপন করা প্রয়োজন ছিল না কিন্তু স্বামীর অবর্তমানের কথা প্রকাশ করা আমাদের দায়িত্ব। কেননা মেয়েরা যতই সাহসিনী হোকনা কেন, মেয়েদের সতর্কতা অবলম্বন করে চলাই খুব জরুরি। এখানে ত পরিবানকে অতবেশি সাহসিনী বলেও মনে হয় না। তা হলে? সূচ্চ প্রাচীরঘেরা একটা বাড়িতে একজন চাকর ও একজন চাকরানী এবং দুটো যমজ শিশুসন্তান কিবা তার বেশি অথবা নিঃসন্তান একজন গৃহিণী যখন বাস করবে তখন তাকে অনেকবেশি সচেতন হওয়ার বা থাকার পরামর্শ আমরা দিব। কারণ মানুষের ঘুমমাত্র মৃত্যু। তাই সাবধানতা অবলম্বন করা এখানে খুব দরকার। কিন্তু এ সাবধানতা পরিবানের মধ্যে আমরা দেখিনি কখনো! যাই হোক, এটা মেয়েদের দোষ বলব না, মেয়েরা যে পুরুষের চেয়ে বুদ্ধিতে একটু খাটো সেটা একদিন প্রমাণ করাব।
পরিবানকে নিয়ে নরিন শেখ ইংল্যান্ড বসবাস করতে পারত তবে এ বসবাসের শান্তির চেয়ে ক্লান্তি বেশি অনুভব করত সে। কারণ যেই সংস্কৃতিতে নরিন বড় হয়েছে সেই সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে তার সন্তানদেরও উদ্বুদ্ধ রাখায় ছিল উদ্দেশ্য। তার কারণ, ভিনদেশি সংস্কৃতিতে যারা বেড়ে উঠে তাদেরকে স্বদেশের সংস্কৃতি কখনো অনুপ্রাণিত করতে পারে না। তারা সহজেই জন্মস্থানকে ভুলে যেতে সক্ষম। তা হলে জন্মদানকারীদের ভুলতে কতক্ষণ। এটা কি তার ভুল ধারণা নাকি সঠিক প্রত্যয় আমরাও তার ঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না। তবে এটাও ঠিক, এমন বিশ্বাস সচরাচর অন্য প্রবাসীদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাই নরিনকে অসাধারণ দেশপ্রেমিক বলতে হবে। কেননা স্বদেশের প্রতি তার যে একটা টান, একটা মমত্ব দেখা গেছে তা সাধারণত অনেক প্রবাসীদের মধ্যে দেখা যায় না। সুতরাং নরিন অশিক্ষিত হলেও এখানে একজন সুশিক্ষিত মানুষের গুণ দেখা যায়। তার প্রমাণ, সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে স্বদেশপ্রীতির আদলে মানুষ করা।
নরিন আর পরিবানের দুটি যমজসন্তানের কথা স্পষ্টভাবে কোথাও উল্লেখ করা না হলেও যতসম্ভব অস্পষ্টভাবে একবার উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু একমাত্র কন্যার কথা এপর্যন্ত একবারও কোথাও অস্পষ্টভাবেও উল্লেখ করা হয়নি–তার নাম শেরিন। তাকে বিয়ে দিয়েছিল করণদ্বীপ ধনাঢ্য এক কুলীন পরিবারে। তার সুখসংসারের কথা এখানে টানব না। শুধু একটুখানি টানতে চাই যমজ দুই পুত্র হিরণ আর কিরণের কথা। হিরণ ডাক্তারি পাস করে হাসপাতাল খুলে ব্যস্ত, কিরণ বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তাদের সংবাদ এপর্যন্ত জানা যায়।
শেরিনের বিবাহের বছর দেড়েক পরের ঘটনা। নরিন শেখের বয়স তখন সাতচল্লিশ কিবা আটচল্লিশ। মেয়েকে আনতে গিয়েছিল তার শ্বশুরবাড়ি। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাশে বড়খাল। গ্রীষ্মকালে কোথাও কোথাও শুকিয়ে পাথর হতে দেখা যেত। আবার বর্ষাকালে দেখা যেত স্রোতের কলকলানিতে কোথাও ভেসে যাচ্ছে দুকূল। খালটার উপর তবে একটা সেতু হবে হবে শুনা যাচ্ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। যোগাযোগব্যবস্থা বলতে গেলে, এপাড় থেকে সব শুরু এবং এপাড়েই সব শেষ। তখন গ্রীষ্মকাল। পায়ে হেঁটে বড়খাল পার হচ্ছে বাপমেয়ে। খালের এপাড়ে একটি ছোট্ট বন। ছোট ছোট অগাছায় এক অপূর্বসৌন্দর্য বর্ধন করে আছে। তার পাশে এলে নরিন মেয়েকে নির্দিষ্ট একটা জায়গা দেখিয়ে দাঁড়াতে বলে। নরিনের…
শেরিন বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবছায়ায়। চোখে কালো চশমা। কপালে লালটিপ। শাড়ি নীলাম্বরি। ঝলমলে বাহারি চুল হওয়ায় উড়ছে অনেকটা। মেয়েরা সুন্দরী হয় বটে তবে শেরিনের মতো সুন্দরীর দেখা খুব কম মিলে। তার মধ্যে এমন এক সৌন্দর্য বিধাতা লুকিয়ে রেখেছে, যা দেখলে সাধারণ কেউ নয় সুন্দরের চুলচেরা বিশ্লেষকগণও আশ্চর্য অনুভব করতে হবে। তার সুন্দরের কাছে সুন্দরীর মুকুটপাওয়া একজন বিশ্বসুন্দরীও তুচ্ছ। একথা তার ঘনিষ্ঠরা নয় নিন্দুকেরাও বলতে শোনা যেত। নরিন প্রস্রাবত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতেই মেয়েকে দেখে হঠাৎ তার মনে কুকামনা জাগে! যা একজন পিতার কল্পনাতেও বিরাজ করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক মানুষের দুটি রূপ থাকে, একটা ভাল অপরটা মন্দ। মন্দ বেশিরভাগ ভালর কাছে পরাজিত হলেও তবে ভালও কখনো মন্দের কাছে পরাজিত হতে দেখা যায়। কিন্তু সত্য কখনো মিথ্যার কাছে পরাজিত হতে দেখা যায়নি। সাক্ষী থাকুক বা নাই থাকুক সত্য একদিন-না-একদিন যেকোনো মোড়ে এসে উন্মোচিত হয়ই। নরিন আর সরাসরি মেয়ের দিকে তাকাতে পারছে না। নিজের মন্দাত্মাকে ধিক্কার দিয়ে চলতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে…
সপ্তাখানেকপর শেরিন শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। পরিবানকে একান্তে ডেকে কাছে বসায় নরিন শেখ। পরিবান স্বামীর আগুনীরূপ দেখে রীতিমতো কাঁপছে এবং ভিতরে ভিতরে ভয়ে আতঙ্কিত হচ্ছে। এত দিনে তার আচার-আচরণে বুঝেছে কিছু একটা ঘটেছে। তবে জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস করতে পারে না। স্বামীকে যতটুকু ভালবাসে তারচেয়ে অনেকবেশি ভয় করে। আর এটাই সম্ভবত বাঙালিস্ত্রীদের চরিত্র। তবে মানুষ ভুল করে জানি কিন্তু কিছু কিছু ভুলের মাশুল দেওয়া যে যায় না তা জানতাম না–
পরি, আমি মনে করি, দুনিয়াতে তুমিই আমার বড় আপনজন। নরিন স্ত্রীর হাতদুটো বুকে চেপে ধরে বলল। তোমার ভালবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ, এত যে ভালবাসি তোমাকে।
পরিবান বলল, হঠাৎ একথা কেন? আমার ত খুব ভয় হচ্ছে।
নরিন বলল, ভয় হওয়ার কী আছে। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, আশা করি মিথ্যা বলবে না।
পরিবান বলল, কথাটা যদি সত্য না হয়? তবেও কি সত্য বলতে হবে?
নরিন বলল, আমার মন বলছে, সত্য।
পরিবান ম্লানহেসে বলল, মনের উপলব্ধি সব সময় যে ঠিক হবে এমন কথা ত নয়?
নরিন গম্ভীরগলায় বলল, আমার উপলব্ধি কখনো বেঠিক হয় না।
পরিবান মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে বলল, কর…
নরিন : তা হলে আমার হাতে হাত রেখে ওয়াদা কর…
পরিবান সঙ্কোচে : করলাম।
নরিন : শেরিন আমার মেয়ে নয়।
পরিবান আকাশ থেকে পড়ে : এ কী বলছ তুমি? তোমার…
নরিন : হাঁ, এটাই সত্য…অর্থাৎ আমার ঔরস্য…
সত্য গোপন করা সততার লক্ষণ নয়। আমরাও সত্যের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার পক্ষপাতি নই। নিজের ঔরসজাত সন্তানের প্রতি একজন নির্বোধ জন্মদাতা যেখানে বদোদ্দেশ্যে আবিষ্ট হতে পারে না সেখানে নরিনের মতো বিবেকবান পিতা! তাই নরিনের সন্দেহ এখানে বুদ্ধিমানের কাজ বলতে হয়। পরিবান কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে, এভাবে কোনেকদিন তাকে সত্যের সম্মুখীন হতে হবে! কারণ, যেকথা দুয়েতে সীমাবদ্ধ থাকে সেকথা তৃতীয়তে উন্মোচন করা দুষ্কর। নরিন শেখের অবর্তমানে দুই পুত্রকে নিয়ে যখন পরিবান ঘুমাত…ছেলেদের বয়স তখন দেড় কিবা দুই। তার ঘুমের কথা যদি বলি, তা হলে অনেকটা দৈত্যের ঘুম বলতে হয়। ঘটনাটা এবার পরিবানের মুখ থেকে শুনি, প্রথমদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে মনে করি…এবং দ্বিতীয়দিনও অবস্থার পরিবর্তন দেখা গেল না! তৃতীয়দিনও তাই…আমার শরীরের লক্ষণ ভাল লাগছে না। এবার ঘুমের ভানে জাগতে থাকি। আমার ধারণা সত্য…তবে…আমি মরে গেলেও দুঃখ ছিল না এবং বাঁচতেও চাইনি তখন। একজন মা সন্তানের জন্মদেওয়াদরদ সহ্য করতে পারে কিন্তু সন্তানহারাবেদনা সহ্য করতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কোন মা আছে, যে সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে? তবে? সন্তানের জন্যে একজন মা কী করতে পারে না।
প্রশ্ন সমীচীন ও অসম্ভব যৌক্তিক। তবে পৃথিবীতে এমন কোন মহামানবও জন্ম নেয়নি যে, এধরণের ভুলকে মেনে নিতে পারে। এখানে ত নরিন শেখ মাত্র একজন মানুষ। তার মধ্যেও যে রাগ-অনুরাগ আছে, ব্যথাবেদনা আছে, অনুভব-অনুভূতি আছে। এমন সত্য শোনে কার মাথায় ভেঙে পড়বে না আকাশ? কোন্ সে মানুষ সত্যকে কাফনে ঢেকে মিথ্যার আশ্রয়ে পথ চলতে পারে? নরিনও তাই পারল না…প্রাচুর্যের গায়ে থুথু ছিটে বলল, একজন চাকর! দেশে কি আইনকানুন বলতে কিছুই ছিল না? বলে নিজের প্রবাসজীবনকে ধিক্কৃত করে…
পরিবান : সবকিছু আছে।
নরিন : তা হলে?
পরিবান : আইন করে হয়তো বিচার পাওয়া যেত তবে আমার সম্ভ্রম পাওয়া যেত না। আর পৃথিবীর এমন কোন আদালত নেই যে, এ জিনিসটাকে ফিরে দিতে পারে।
নরিন : তা হলে আমার কাছ থেকে গোপন করলে কেন?
পরিবান : তোমাকে হারাব বলে। সেই সিদ্ধান্ত হয়তোবা আমার ভুল ছিল, তার জন্যে যত শাস্তি আছে মাথাপেতে নিতে চাই।
নরিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল এবং বলল, কিছু কিছু ভুলের জন্যে আত্মহত্যা করা যায় তবে মাফ করা যায় না। বলে ওঠে দাঁড়াতেই পরিবান স্বামীর পাদুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল এবং মিনতির সঙ্গে স্বামীস্ত্রীর পবিত্র ভালবাসার দোহাই দিয়ে বলল, এবয়সে তাকে ত্যাগ করে মান্যগণ্য ছেলেমেয়েদের কাছে যেন ছোট করা না হয়।
কলঙ্কিত জীবনের চেয়ে আত্মহত্যা ভাল। কিন্তু আত্মহত্যায় কলঙ্কের সমাধান নয়। যারা আত্মহননে সমাধান খুঁজে তাদেরকে আমরা মুক্তির পথ দেখাব কিভাবে? এখানে তবে পরিবানের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মিলে। তাকে আমরা যতটুকু বোকা মনে করি ততটুকু বোকা কিন্তু পরি নয়।
নরিন প্রায় দিশেহারা। চোখের ঘুম চলে গেছে। কী করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না। সারা রাত জেগে জেগে সমাধান খুঁজতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা যায় তবে আজীবন বিবেকের প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকা যায় না। এমন তেতো কথা জানার পর সংসারের প্রতি যেকারও দূরত্ব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। শেরিন যে নরিনের রক্ত নয় একথা শেরিনের চিরদিন অজানা থাকবে এমন কথাও নয়। তবু তার কথা নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের কথা ত আর বাদ দেওয়া যায় না। আজ নাহয় কাল বা কোনেকদিন আচার-আচরণে ছেলেরা যে জানতে পারবে না এমন কথা কে বলে। অদৃষ্টের লিখা যেমন খণ্ডানো যায় না দৃষ্টের চিহ্নও ত তেমন মুছে ফেলা যায় না। তাই ছেলেদের সম্মানার্থে এবং ছেলেমেয়েদের সামনে স্ত্রীর উদারত্বরক্ষার্থে এখান থেকে চলে যাওয়া জরুরি মনে করল নরিন। কারণ, এখানে সুখ ত পাবে। তবে শান্তি পাবে না। সুখের চেয়ে শান্তি বড়।
যেকাজে দশের মঙ্গল হয় সেকাজে একের অমঙ্গল ভাল। এবং যেস্থান কষ্টের ইয়াদগার বেশি সেস্থান ত্যাগ করা আমরাও ভাল মনে করি। নরিন শেখের নিখোঁজসংবাদ অত্মীয়-বন্ধুবান্ধব প্রায় সকল ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই কৌতূহলী–কোথায় যেতে পারে? আর ঝগড়াঝাটি নেই, রাগের কোন কথা নেই, তা হলে নীরবেনিশ্চুপে হঠাৎ একজন মানুষ এভাবে সংসারবিমুখ হয়ে কেনইবা অদৃশ্য হবে! অনেকের অনেক মন্তব্য, অনেক জিজ্ঞেসা এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর কথা উঠল পেপারপত্রিকায় ঘোষণার। তারপর এমন কোনো সংবাদমাধ্যম নেই যেখানে নরিন শেখের সন্ধানখবর প্রচার করা হয়নি। কিন্তু কোন হদিস মিলেনি।
সেথেকে বহু বছর কেটে গেল। শুধু আত্মীয়স্বজনেরা নয় তার ছেলেমেয়েরাও প্রায় ভুলতে বসেছে তার কথা। কারণ তাদের ধারণা, তাদের বাবা বেঁচে নেই। স্ত্রী একমাত্র মাঝে মাঝে স্মরণে তুলে কাঁদত। তার ধারণা, সে জীবিত আছে।
একদিন–প্রায় চব্বিশ বছরপর এক দৈনিকপত্রিকার শিরোনাম হয় সড়কদুর্ঘটনার একটা মর্মান্তিক খবর, জনৈক পথচারী মারাত্মক আহত অবস্থায় রায়গড় জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছে। আহতের ঠিকানা উদ্ধারের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বয়স আনুমানিক সত্তরের কাছাকাছি। মানিব্যাগে প্রায় নষ্ট একটা ছবি ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণ মিলেনি। তিন শিশুর সঙ্গে এক মহিলার ছবি। সম্ভবত পরিবারবর্গ। আহতের পরিচয়োদ্ধারের লক্ষ্যে ছবিটা পত্রিকায় ছাপানো হল। পরিবারের কেউ থাকলে সত্বর যোগাযোগ করুন। মুমূর্ষুর রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ…এমন দুর্লভ রক্ত বর্তমানে আমাদের সংগ্রহশালায় নেই। এবং কোন উদার মনের মানুষ থাকলে নিঃস্বকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন…
কিরণ পেপার দেখে জোরগলায় ভাই হিরণকে ডাকে। তার ভয়ার্তকণ্ঠ শোনে পরিবারের সকলে যার যার রুম থেকে দ্রুত ছুটে আসে হলরুমে। এ ঘরটাকে অনেকটা মহলও বলা যেতে পারে। কতূহল জানার পর অবাকচোখে পত্রিকাটি সকলে কাড়াকাড়ি করে দেখে। ভাগ্যক্রমে তার আগের দিন শেরিনও বাপের বাড়ি বেড়াইতে এসেছে। তাদের শহর থেকে রায়গড় হাসপাতাল প্রায় সাত-আটশ কিলোমিটারের পথ। তবে যেখানে রক্তের টান সেখানে দূরত্ব কোন বাধা হতে পারে না।
নরিন বেহুঁশ। মুখে অক্সিজেনমাস্ক লাগানো এবং সমস্ত শরীর ব্যান্ডিজে বাঁধা। তবু তাকে চিনতে স্ত্রী-সন্তানদের এতটুকু কষ্ট হয়নি। কক্ষটি পরিপাটি। ফ্লোরে বসে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদতে থাকে শেরিন এবং তার পাশে গম্ভিরমুখে দাঁড়িয়ে থাকে তার যুবকযুবতী দুই ছেলেমেয়ে। তিনটা মাত্র চেয়ার। তাই খাটের একপাশে বসে নাড়ি দেখে হিরণ এবং তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে থাকে কিরণ। শিয়রে দাঁড়ানো দুই পুত্রবধূ এবং তাদের একটি একটি করে দুটি বার-তের বছরের ছেলেমেয়ে। সকলের চোখে দরদের অশ্রু। খাটের আরেকপাশে বসে পলকহীন চোখে মুখের দিকে চেয়ে আছে প্রাণের স্ত্রী পরিবান–নীরবে চোখের পানি ফেলছে আর মনে মনে ভাবছে, প্রত্যেক মানুষের কাছে বিশেষ একটি দিন গুরত্বপূর্ণ। আমার কাছেও ছিল। এমন ভুলের জন্যে সেই দিনের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। এধরণের ভুল সংশোধনের যোগ্য নয় ঠিক। কিন্তু যেভুল নিজের অজান্তে বা অমতে হয় সেটাকে ভুল বলা যায় না। তবু আমি সমস্ত ভুল একান্ত আমার বলে স্বীকার করে নিলাম এবং মাথাপেতে যেকোনো শাস্তি ভোগ করতে প্রস্তুত ছিলাম। তার পরেও ওর ভুল ভাঙল না কেন? কাণ্ডজ্ঞানহীন বালকের মতো একেমন কাণ্ড করল সে! ভুল মানুষেতে হয় দেবতাতে নয়। তবে এভুলের আফসোস শুধু ওকেই নয় আমাকেও বোধহয় মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তাড়িত করবে! কিন্তু ওকে যে অন্ধকারে রাখিনি এবং খোদার মতো ভালবেসেছিলেম সেটা ও ভুল জানলেও অন্তর্যামী অবশ্য নির্ভুল জানেন, তাঁর কাছেই সেটার প্রমাণ ও প্রতিদান আশা করি।
তিন দিনপর জ্ঞান ফিরে নরিনের। আবছা আবছা দেখে প্রথমে। তারপর চোখ ঘুরিয়ে পরিষ্কার দেখে নেয় পরিবারের সকলকে একবার। সঙ্গে সঙ্গে দুচোখ বেয়ে তার বয়ে চলে বিরহশোকের অশ্রু। প্রাণপ্রিয় সন্তানদেরকে বুকে ঝাপটিয়ে ধরে চুমু খেতে চাইল মন তৎক্ষণাৎ। ভুলের সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে সন্তানদের সুখের সংসারে ফিরে যেতে চাইল মন এবার। অম্লজানমুখোশ ছুড়েফেলে পরিবারের সবার সঙ্গে প্রাণখুলে মাততে চাইল মন বারবার। সব দোষদুঃখ ভুলে স্ত্রীকে আপন করে নিতে চাইল মন আবার। এবং আবার হাসিখুশি জীবন গড়তে চাইল মন আগের মতো। আবার নতুন করে বাঁচতে চাইল মন। কিন্তু না, কিছু জিনিসের নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলেও মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে কিছুটা চলতে পারে। তবে মানুষের কোনো মেয়াদোত্তীর্ণ সময়সীমা নেই। তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলে যেতে হয়। স্ত্রী-সন্তানদের শোকের সমুদ্রে ভাসিয়ে দুঃখের বিরাট এক বোঝা নিয়ে নরিন শেখ চলে যায়, রেখে যায় এমন কিছু ভুলের জন্যে নিদর্শন। পরিবান অপরাধীর করতলে দেবে কিছু দিন বেঁচেছিল জিন্দালাশ। মানুষেতে এমন কতক ভুল হয়ে যায় যেগুলোকে সংশোধন করাও যায় না এবং প্রায়শ্চিত্ত করাও যায় না। এমন ভুলের জন্যে অনেককে জীবন বিসর্জন দিতেও দেখা যায়। এখানে তবে মেয়েদের বুদ্ধিখর্বতার পরিচয় পাওয়া যায়।
||আপডেট: ০৬:৪৪ অপরাহ্ন, ০২ এপ্রিল ২০১৬, শনিবার
চাঁদপুর টাইমস /এমআরআর