ভিডিওতে র‌্যাবের নিকট চাঞ্চল্যকর যা বলেছেন নূর হোসেন

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার অন্যতম আসামি নূর হোসেন বলেছেন, ‘আমার প্রধান শত্রু ছিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম। তাকে দুনিয়া থেকে সরানোর জন্য যা যা করার দরকার ছিল সেই চেষ্টাই ছিল আমার। সে আমার অনেক ক্ষতি করেছে।

রাজনৈতিকভাবেও সে আমাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। এই কারণে তাকে মেরে ফেলতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের সাথে চুক্তি করি। তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। প্রথমে মেজর আরিফ হোসেনের সঙ্গে অর্থের পরিমাণ নিয়ে দরকষাকষি হয়। র‌্যাব কর্মকর্তাদের বলি, নজরুলকে মারতে পারলে আপনাদের কোটি টাকা দেওয়া হবে।

এই ঘটনার আগে র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন সিও লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে তাঁর অফিসে একাধিকবার দেখা হয়েছে। তা ছাড়া মেজর আরিফ আমার বাসায় এসে টাকা নিয়ে গেছেন।’

গত বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা থেকে ফিরিয়ে ঢাকায় আনার সময় র‌্যাবের কাছে এসব কথা বলেন নূর হোসেন। ওই সব কথাবার্তা ভিডিওতে ধারণ করে রাখা হয়েছে। র‌্যাবের একটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, নূর হোসেন বলেছেন, সাত খুনের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব অফিসের কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউ জানতেন না। তবে নজরুলসহ অন্যদের অপহরণের বিষয়টি জানত এলাকার কিছু নেতাকর্মী। অ্যাডভোকেট চন্দন কুমারসহ ছয়জনকে হত্যা করার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন নূর হোসেন।

তিনি বলেন, ‘ওই ছয়জনের মৃত্যুর জন্য র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তারাই দায়ী। তারা অতি-উৎসাহী হয়ে নিরপরাধ ছয়জনকে মেরে ফেলেছে। তাদের মেরে ফেলার আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তারেক সাঈদের সাথে অ্যাডভোকেট চন্দনের বিরোধ ছিল আমি জানি। আর সে গোপনে ওই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।’

নূর হোসেন র‌্যাবকে বলেন, ‘ঘটনার পর ক্রসফায়ারের ভয়ে আমি কলকাতায় পালিয়ে যাই।’ তিনি দাবি করেন, নজরুলকে হত্যা করায় রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয় অনেকেই।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর সাত খুনের সঙ্গে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় শক্ত হাতে তদন্ত শুরু করি। র‌্যাবের তৎকালীন কর্মকর্তাদের মোবাইল ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হই এ হত্যাকা-ের সাথে তারাই জড়িত। তাদের র‌্যাব সদর দপ্তরে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে। তাদের স্বীকারোক্তিও রেকর্ড করে রাখা হয়। নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে নানাভাবে চেষ্টা চালাই।

সরকারের নির্দেশে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নূর হোসেনকে হস্তান্তর করার আগে বিএসএফের কর্তৃপক্ষ আমাকে এসএমএস করে জানতে চায় আমি উপস্থিত আছি কি না। তাদের ফিরতি এসএমএস দিয়ে বলি আমি উপস্থিত আছি। তারপর আমার সামনেই নূর হোসেনকে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িতে নূর হোসেন অনেক কথাই বলেছেন। তাঁর কী কী পরিকল্পনা ছিল, কোথায় টাকা পেয়েছেন বা কে লাভবান হয়েছেন তাও বলেছেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নূর হোসেনকে হস্তান্তর করার পরপরই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তাঁকে র‌্যাবের একটি গাড়িতে উঠানো হয়। ওই সময় তাঁর চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। শরীর কাঁপছিল। তখন র‌্যাব কর্মকর্তারা তাঁর কাছে কাঁপার কারণ জানতে চান। উত্তরে নূর হোসেন বলেন, ‘স্যার আমার ভয় লাগছে।’ র‌্যাব কর্মকর্তারা তখন তাঁকে অভয় দিয়ে যা সত্যি তাই বলতে বলেন।

তখন নূর হোসেন বলেন, ‘স্যার সব কিছু বলব। তাদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, র‌্যাব কর্মকর্তাদের কত টাকা দেওয়া হয়েছে, পরিকল্পনা কী ছিল তার ফিরিস্তি তুলে ধরব আপনাদের কাছে।’ নূর হোসেন র‌্যাব কর্মকর্তাদের বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি করার পেছনে আমার অবদান সবচেয়ে বেশি।

‘বিএনপি সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আমিই টিকিয়ে রেখেছি। এমনকি ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি জ্বালাও পোড়াও করে আসছিল। তারা লংমার্চ করেছিল। বিএনপির ওই লংমার্চ নারায়ণগঞ্জ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমিই সেই নূর হোসেন যে রাস্তায় ট্রাক ফেলে দিয়ে তাদের লংমার্চ পণ্ড করে দিয়েছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়েই নাসিকের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের সঙ্গে বিরোধ বাধে।’

সূত্র মতে, নূর হোসেন আরো বলেন, ‘একসময় আমি জাতীয় পার্টি ও বিএনপির রাজনীতি করতাম। আমার আত্মীয়স্বজনও বিভিন্ন দলের রাজনীতি করে।’

অঢেল ধন-সম্পদ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে স্যার আমি পড়ালেখা জানি না। প্রথমে ট্রাক ড্রাইভার ছিলাম। পরে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার কাছ থেকে এমন কোনো লোক নেই যারা টাকা-পয়সা নেয়নি। পুলিশ, র‌্যাব, রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় সাংবাদিক নিয়মিত টাকা নিত। অনেকের বিয়ের বাজার পর্যন্ত করে দিয়েছি।’

ওই সময় র‌্যাবের এক কর্মকর্তা সাত খুনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন নূর হোসেন। পরে তিনি বলেন, ‘স্যার আবারও বলছি, নজরুল ছিল আমার প্রধান শত্রু। তাকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যই আমি পরিকল্পনা করি। অন্য কারোর পরিকল্পনা ছিল না। তাকে হত্যা করতে প্রথমে র‌্যাবের মেজর আরিফের সাথে যোগাযোগ করি। আরিফের সঙ্গে আগে থেকেই আমার যোগাযোগ ছিল। তিনি সব সময় আমার আস্তানায় আসতেন। সেই সুবাদে তাঁকে বলি, স্যার, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। কাউন্সিলর নজরুলকে মেরে ফেলতে হবে।’

তখন আরিফ বলেন, ‘এতে আমাদের লাভ কী?’ তখন আমি বলি, আপনাদের অব্যশই খুশি করা হবে। আরিফ আমার সামনে সিও তারেক সাঈদ ও কমান্ডার রানাকে ফোন করেন। আরিফের কথামতো আমি সিওর সঙ্গে তাঁর দপ্তরে দেখা করি। সিওকে বলি, নজরুলকে মারতে পারলে আপনাদের এক কোটি টাকা দেওয়া হবে। পরে আরিফের কাছে দেওয়া হয় আগাম ১০ লাখ টাকা। মেজর আরিফ আমাকে বলেন, ‘নজরুলকে কিভাবে আমরা পাকড়াও করব?’ তখন আমি বলি, নজরুলের বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা আছে। সে হাইকোর্ট-জজকোর্টসহ সব কোর্টেই আসা-যাওয়া করে। সে কখন আদালতে যাবে তা আপনাদের জানানো আমার কাজ। এটা আমার উপর ছেড়ে দিন।’

নূর হোসেন বলেন, ‘২৭ এপ্রিল নজরুল আদালত থেকে বের হওয়ার পরপর আমি আরিফকে ফোন করি। তখন আরিফ বলেন, ‘সব রেডি আছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’ পরে নজরুলকে অপহরণ করার পর আরিফ আমাকে বলেন, ‘অপারেশন সফল হয়েছে। এখন তাকে মারার দায়িত্ব আমাদের।’ এ কথা শোনার পর আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। খুশির চোটে সিও সাহেবকে ফোন করি, বলি- স্যার, তাকে মেরে এমন জায়গায় রাখবেন কেউ যেন টের না পায়। এ সময় সিও সাহেব বলেছিলেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’ ওই সময় সিও বা মেজর আরিফ একটিবারের জন্য বলেননি নজরুলের সাথে অ্যাডভোকেট চন্দনসহ আরো ছয়জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এ কথা যদি আমি জানতাম তাহলে তাদের মারার জন্য নিষেধ করতাম।’

র‌্যাব কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে নূর হোসেন বলেন, ‘২৭ এপ্রিল রাত ১২টা কিংবা সাড়ে ১২টার দিকে মেজর আরিফ ফোন দিয়ে বলেন, ‘নজরুলসহ সাতজনকে আমরা মেরে ফেলেছি।’ তখন আমি এর প্রতিবাদ করে বলি, আমার পরিকল্পনায় ছিল শুধু নজরুল। আপনেরা অন্যদের মারলেন কেন? এটা ঠিক করেননি। তখন আরিফ আমাকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বাঁচিয়ে রাখলে সবার বিপদ হবে। আর এই কারণেই তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। সিও স্যারও বলেছেন সবাইকে মেরে ফেলতে। এখন এসব কথা বাদ দিয়ে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিয়ে দেন। সিও স্যারের সাথে ২৮ এপ্রিল দেখা করবেন।’

আরিফ আশ্বস্ত করে বলেন, লাশ এমন স্থানে রাখা হবে কেউ জানতে পারবে না। তাঁর কথা অনুযায়ী ঘটনার পরের দিন সিও সাহেবের সাথে দেখা করে আসি। সিও আমাদের ভয় পেতে নিষেধ করেন। লাশগুলো পানির নিচে চাপা দেওয়ার সময় আরিফ আমার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করতেন। তবে কমান্ডার রানা আমাকে ফোন দিতেন না। তাঁর সাথে আমার তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না।’

নূর হোসেন জানান, হত্যাকাণ্ডের কথা র‌্যাবের তখনকার সিও, মেজর আরিফ, কমান্ডার রানাসহ অপারেশনে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই শুধু জানতেন। এর বাইরে কেউ জানত না।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, গল্পের ছলে নূর হোসেনের কাছ থেকে এসব কথা আদায় করা হয়। কথাগুলো রেকর্ড করা হয়েছে। হস্তান্তরের সময় নূর হোসেন খুব আতঙ্কে ছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বাংলাদেশে আসার পরপরই ক্রসফায়ারে মারা যাবেন। আর যখন বুঝতে পারেন তিনি আর মারা যাবেন না, তখনই তাঁর মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। আদালতে ওঠানো এবং কারাগারে নেওয়ার সময় সেই হাসিই লেগে ছিল।

ওই কর্মকর্তা জানান, মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে র‌্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সিও লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানা, ল্যান্স নায়েক বিল্লাল হোসেন, সাবেক এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার মো. ইমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. সিহাব উদ্দিন, রেডিও অপারেটর গেইন (আরওজি) আরিফ হোসেন, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার ও গাড়িচালক নাসিরউদ্দিন, সিপাহি নূরুজ্জামান, বাবুল হাছান ও সিপাহি আসাদুজ্জামানকে র‌্যাবই গ্রেপ্তার করে পুলিশে সোপর্দ করে। (কালেরকণ্ঠ)
নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট: ০৪:২৫ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০১৫, সোমবার

ডিএইচ

Share