সারাদেশ

ভাড়ায় থাকা ’ব্যাচেলর’ জীবন মানেই মহাবিড়ম্বনা

রাজধানী কিংবা জেলা শহরে ব্যাচেলর মানেই বিড়ম্বনার জীবন। হোউক সে ছাত্র কিংবা কর্মজীবী। উভয়ের জন্যই বিষয়টি বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেলে না বাড়ি ভাড়া। বাড়ি ভাড়ার জন্য ঘুরতে ঘুরতে নোটিশ দেখে থমকে দাঁড়াতে হয়। লেখা থাকে ‘ব্যাচেলর ভাড়া দেয়া হয় না’।

এই যন্ত্রণা কেবল ব্যাচেলরদের বেলাতেই তা নয়। অনেক সময় ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’রাও এর শিকার হন। স্ত্রীকে গ্রামে রেখে ঢাকায় এলেই তারাও বিবেচিত হন ‘ব্যাচেলর’ হিসেবে।

আর অনেক কষ্টে বাড়ি ভাড়া মিললেও যত দোষ বেচারা ব্যাচেলরের! বারান্দায় যায়, উকি মারে, বান্ধবীকে বোন পরিচয়ে বাসায় নিয়ে আসে, রাতে দেরিতে ফেরে, উচ্চ শব্দে গান শোনে এমন শত অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।

অনেক ব্যাচেলরই বলতে বাধ্য হন- ‘মেয়ে বিয়ে দিতে কোনো বাড়িওয়ালাতো আর বিবাহিত ছেলে খোঁজেন না।’

অনেকদিন পর এক আত্মীয়ের বিয়েতে গেছেন ৩৭ বছর বয়সী ব্যবসায়ী জর্জ ডি কস্তা। বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই হয়ে গেলেন সম্ভাব্য একজন পাত্র।

অপরিচিত এক অবিবাহিত নারীকে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে গায়েব হয়ে গেলেন আত্মীয়রা। পাত্রী দেখতে আসেননি, তবুও চালিয়ে যেতে হল অস্বস্তিকর আলাপচারিতা।

কিছুক্ষণ পর আত্মীয়দের প্রশ্ন-মেয়ে পছন্দ হয়েছে? কস্তার না উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন- কেন?

বাংলাদেশে জর্জ ডি কস্তার মতো অবিবাহিত মানুষদের প্রায়ই বিয়ে নিয়ে অযাচিত সব প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।

এখনো বিয়ে করোনি? কেন করোনি? কবে করবে? ইত্যাদি।

পাড়ার চাচা অথবা দুঃসম্পর্কের খালাকে হাসিমুখে এসব প্রশ্নের জবার দিয়ে উতরে গেলেও জর্জ ডি কস্তা পার পাননি ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে।

প্রথমেই শুনতে হয় পরিবার নিয়ে থাকবো কিনা সেই প্রশ্ন। একা থাকবো শুনলেই বাড়িওয়ালাদের মধ্যে বিরূপ একধরনের মনোভাব দেখা যায়। বিষয়টা যেন একটা খুবই দৃষ্টিকটু ব্যাপার।

বাড়িভাড়া জোটে না বলে শেষ-মেষ আত্মীয় বা বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকতে হয় অনেক অবিবাহিত নারী-পুরুষকে।

বাংলাদেশে সামাজিক রীতিতে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেননি এমন মানুষদের জীবনাচরণের উল্টোটাই স্বাভাবিক।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ একটি নির্দিষ্ট বয়সে বিয়ে করে সংসারী হবেন তেমনটাই এখানে নিয়ম। আর বিয়ের ক’দিন পর ছেলেপুলের দায়িত্ব নেবেন সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু ইদানিং এই সামাজিক রীতি বদলে বিয়ের পিড়িতে না বসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশের শহরগুলোতে।

একটু বেশি বয়সে বিয়ের প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে যেমন বাড়ছে, তেমনি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ের বদলে অনেক নারীও আগ্রহী হচ্ছেন পেশার দিকে।

তবে সামাজিক রীতেতে এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বিড়ম্বনায়ও।

৩৯ বছর বয়সী ঢাকার একজন নারী আইনজীবী বলেন, যত যোগ্যতাই তার থাকুক না কেন বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে মিথ্যে বলতে হয়েছে অনেকবার। সামাজিক প্রথার ব্যত্যয় করেছেন বলে তাকে পরতে হয়েছে সন্দেহের তালিকায়।

তিনি বলেন, প্রথমত মিথ্যা বলে বাসা নিতে হয়েছিল যে, আমার সঙ্গে মা থাকবেন। পরে যখন আমার বাসায় কোনো বন্ধু বা পুরুষ সহকর্মী কাজে আসত তখন খেয়াল করতাম বাড়িওয়ালা বা প্রতিবেশীরা নজর রাখছেন।

ভাল আয় করেন এবং অনেকগুলো ডিগ্রিধারী এই নারী নিজের পাড়াতেই কখনো হয়ে উঠেছেন গুজব বা রসালো কানকথার উৎস।

অনেকেই মনে করেন বিয়ে হচ্ছে না তাহলে বোধহয় মেয়ের কোনো খুত (সমস্যা) আছে। আবার ইচ্ছে করে বিয়ে করছেন না এমন বুঝতে পারলে তারা ভাবতে থাকে কারণটা কি? সেগুলো নিয়ে পেছনে কথা বলা বা নানান নেতিবাচক চিন্তা তাদের মনের মধ্যে চলে আসে।

ভাড়া বাড়িতে পাড়ার ছেলেদের কাছে হয়রানির শিকার হয়ে এই আইনজীবী শেষ মেষ ফিরে গেছেন পরিবারের কাছে।

তবে সেই সুবিধা নেই জীবিকার তাগিদে ঢাকার বাইরে থেকে শহরে আসা অনেকের।

সেরকম একজন বিয়ের আগে ঢাকায় একটা বাড়িতে উঠেছিলেন। সেই বাড়িতে তাকে ব্যাচেলর বলে অনেক নিয়মকানুন দিয়ে দেয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, বাড়ির বারান্দায় যেতে পারতাম না। ছাদে যেতে পারতাম না। এমনকি জানালা খোলাও নিষেধ ছিল। তাই অফিস শেষ করে বন্ধ ঘরে থাকতে হতো। সেটাই এখানে নিয়ম।

৯টা-৫টা অফিস আর তারপর জানালা বন্ধ ঘরে থাকা এইসব ব্যাচেলরদের প্রায়ই দেখতে হয়- ‘এখানে ব্যাচেলরদের বাড়িভাড়া দেয়া হয়না’এমন নোটিশ।

ঢাকার প্রায় সব বাড়িওয়ালাদের কাছে অবিবাহিত মানেই ‘উটকো ব্যাচেলর’ মাত্র।

ঢাকার মগবাজারের নয়াটোলায় একটি বাড়ির মালিক রাজিয়া সুলতানা জানান- অবিবাহিত ভাড়াটে নিয়ে তাদের বেশ আপত্তি কারণ অন্য ভাড়াটেদের বিষয়টা পছন্দ না।

তিনি বলেন, ‘ওরা দেরি করে ঘরে ফেরে। প্রায়ই বান্ধবীরা রাতে থাকত আর আমাদের বলা হতো বোন। এসব নিয়ে পরে আমার অন্য ভাড়াটেরা আপত্তি করলে ওদের বিদায় করে দিতে হয়েছে।’

কোনো বাড়িওয়ালা বিদায় করে দিলেও এই মানুষগুলো বাংলাদেশের সমাজেই থাকেন।

সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজ এখন একটি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই মানুষদের উপস্থিতি তারই নমুনা। জীবনের প্রয়োজনেই প্রথাগত জীবনধারায় এই ধরনের পরিবর্তন আসছে। ইদানিং শিক্ষায় পরিবর্তন হয়েছে সেটাও একটা কারণ। অনেকক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণেও বাড়ছে দেরিতে বিয়ে করা মানুষের সংখ্যা।’

মাহবুবা নাসরিনের মতে- এই পরিবর্তন শুরু হলেও মানুষের মনোভাব অবশ্য বদলাচ্ছে বেশ ধীরে ধীরে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সমাজে রয়েছে ভিন্নতায় অরুচি। নতুন ধরনের এই জীবনাচরণের জন্য প্রস্তুতও নয় বাংলাদেশের সমাজ। অধ্যাপক নাসরিনের মতে সেখানেই দ্বন্দ্ব।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সামাজিকীকরণটাই হল একটি বয়সের পর বিয়ে করে মানুষ সংসারী হবে। সবাই একই রকম হবে। অবিবাহিত নারী-পুরুষের সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাসের সংস্কৃতি। নিরাপত্তার আশঙ্কা থেকে একটু ভিন্ন ধরনের মানুষের প্রতি তাই নেতিবাচক মনোভাব।

সেই মনোভাব না বদলানো পর্যন্ত জর্জ ডি কস্তার মতো মানুষেরা রয়ে যাবেন ‘উটকো ব্যাচেলরের’ তালিকায়।

May 16, 2015 @ 04 : 12 চাঁদপুর টাইমস ডেস্ক:

Share