ফিচার

ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি, উদ্দেশ্য ও ইসলাম প্রসঙ্গ

“ভালবাসা দিবস” নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে দিবস শব্দটি নিয়ে আলোচনা শুরু করি দিবস এটি বাংলা শব্দ প্রতিশব্দ হচ্ছে দিন। দিবস শব্দটি কয়েটি আঙ্গিকে ব্যবহার হয়ে থাকে।

সাধারণত মর্যাদাসূচক দিনগুলোর সাথে আমরা দিনের বিপরীতে দিবস ব্যবহার করে থাকি। যেমন জাতীয় দিবসগুলোর কয়েকটি হলো মহান স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস, জাতীয় বুদ্ধিজীবি দিবস, জাতীয় টিকা দিবস, জাতীয় সমবায় দিবস সহ আরো অনেক।

আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর মধ্যে রয়েছ মার্তৃভাষা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস, প্রবীণ দিবসসহ আরো অনেক। ধর্মীয় দিবসগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলমানদের দুই ঈদ, হিন্দুদের পূজাসমূহ, খ্রীষ্টানদের বড় দিন, বৌদ্ধদের মাঘি পূর্নিমা ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হলো ভালবাসা দিবসটি কোন ধরনের দিবস? যারা ভালবাসা দিবস নিয়ে অনেক হৈ-হুল্লোড় করে থাকেন তার এর সোজা উত্তরটি অনেকেই দিয়ে থাকেন এভাবে যে, ভালবাসা দিবস তো ভালাবাসার জন্য। এই দিনে মানুষ তার পছন্দের মানুষটিকে প্রাণ ভরে ভালবাসবে, কিছু উপহার দিবে, সাক্ষাত করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুনরায় যদি প্রশ্ন করা হয় ভালবাসা দিবসের উৎপত্তি কোথায় থেকে, গোজামীলযুক্ত জবাব ছাড়া কোন সঠিক উত্তর পাওয়া দুষ্কর। প্রতিবেদনটি পড়ে দয়া করে এটা মনে করবেন না যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসার বিরোধী। ভালবাসা আমি নই শুধু পশু পাখি সহ সবার মাঝেই রয়েছে। জাতিভেদে ভালাবাসার ধরনটা ভিন্ন। যেমন আমার প্রতি ও আমার লেখার প্রতি ভালবাসা না থাকলে তো পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতো না। তবে আমি ভালবাসাকে নির্দিষ্ট দিনে আবদ্ধ করার বিপক্ষে।

আমাদের মুসলমানদের বিশেষ করে বাঙ্গালী জাতির ভালবাসা প্রতিটি দিন, প্রতিটি বছর প্রতিটি যুগ সহ পূর্ববর্তী ইতিহাসের পরিক্রমায় আরো নিকটে গেলে প্রতিটি মুহুর্তেই ভালবাসায় ভরা। ভালবাসার জন্য আমাদের নির্দিষ্ট দিনের দরকার হয় না। তাই ভালবাসাকে আমরা নির্দিষ্ট দিন বা কোন ফ্রেমের মধ্যে আবদ্ধ করে খাটো করতে চাই না। তবে সারপ্রাইজড হিসেবে ভালবাসা দিবসকে অনুসরণ করলেও সেটি শেষ পর্যন্ত সারপ্রাইজড হিসেবে থাকে না চলে যায় অশ্লীলতার মধ্যে।

ভালবাসা দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নামে যে অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন করা হয়, তা শুধু ধর্মীয় চেতনার সাথেই সাংঘর্ষিক তা নয়, রীতিমত এগুলো বাঙ্গালী সংস্কৃতি ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ার। কেনো আমাদের প্রয়োজন হবে ভালবাসা দিবসের? যেখানে আমাকে আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব ভালবাসতেছে আমিও তাদের ভালবাসতেছি। আমার সাথে যদি তাদের কোন বিষয়ে মনোমালিন্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটা একে অপরের প্রতি প্রবল ভালবাসা জন্যই হয়েছে। একটি ভিন্ন আঙ্গীকে যদি বলা হয় যে ভালবাসা দিবস প্রেমিক-প্রেমীকাদের জন্য কিংবা স্বামী-স্ত্রীর জন্য।

তাহলেও একমত হতে পারা যায় না, কেননা প্রেমিক- প্রেমিকা একে অপরকে ভালবাসে যতদিন সম্পর্কটি টিকে থাকে।

তাদের ভালবাসার প্রাথমিক কারণ হলো এই ভালবাসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। এখন যদি তারা শুধু নির্দিষ্ট ১টি দিনে ভালবাসা বিনিময় করতে চায় তাহলে ভালবাসা টিকার জন্য এ দিনটি কতুটুকোই বা ভূমিকা রাখতে পারে। অপরদিকে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসার মাধ্যমে যদি বুঝতে চাই- তাও একমত হওয়া যায় না। স্বামী তার স্ত্রীকে ভালবাসে তার সাধ্যমতো তার ভরণ পোষনের ব্যবস্থা করে বিপরীতে স্ত্রীও স্বামীকে ভালবাসে বাস্তবতার নিরিখে এবং স্বামীর সংসার করে, অনেক স্ত্রী আবার স্বামীর সংসার করার পাশাপাশি আয়-রোজগারও করে থাকে।

এটি কেন করে? শুধুই বাস্তবিক ভালবাসার কারনে। এখন আমরা চাইলেও এ বিষয়গুলোকে ১টি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে পারবো না। এই দিবসটির বিপক্ষে অবস্থানকারীদের একটি সন্তুষ্টির বিষয় রয়েছে এই দিবসটিকে এখনো রাষ্ট্রীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা কিংবা এই দিবসটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা হয় না।

তবে সাথেসাথে একটি আশংকাও রয়েছে, সেটি হলো ভালবাসা দিবসের পক্ষে তরুণ-তরুণীদের যে উপচে পড়া সমর্থন দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় ওই দিন আর বেশি দুর নয় যে, ভালবাসা দিবসটিকে জাতীয় দিবস কিংবা এই দিবসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার জন্য আন্দোলন করা হবে না।

যেহেতু এই দিবসটির উৎপত্তি হয়েছে তাহলে এখন আসুন জেনে নেই দিবসটি কাদের জন্য প্রয়োজন।

প্রথমে বলি এটি সুন্দরবন কিংবা আফ্রিকার জংগলের পশু-পাখির জন্য উৎপত্তি হয় নি। উৎপত্তি হয়েছেই মানুষের জন্য। এখন এই মানুষগুলো কারা? এই মানুষগুলো হলো নোংরা সংস্কৃতির লালনকারী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তীধর (সভ্য নয়) সভ্যতার দাবিদার ইউরোপ, আমেরিকা ও ব্রিটিশদের জন্য। কেননা তাদের মাঝে প্রকৃত ভালবাসা অনুপুস্থিত। সেসব জাতিসমূহের মাঝে প্রকৃত ভালাবাসা পাওয়া যায় না, যেখানে মা তার সন্তানকে ভালবাসে না, সন্তান ও তার মাকে ভালবাসে না। বাবার কথা নাই বললাম, কেননা তাদের আবার বাবার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিধায় বাবার পরিচয় দেওয়া তাদের রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ। মা-বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে।

অবাধে বিচরন ও যৌনাচারের জন্য তাদের মাঝে একধরনের ভালবাসা রয়েছে তাও আবার সাময়িক। যে ভালবাসাকে তাদের ভাষায় বলা হয় টাইম পাস। এখন আমাদের দেশেও ভালবাসা দিবসে এমন কিছুর সরাসরি আভাস পাওয়া না গেলেও পূর্ববর্তী লক্ষণগুলি অবলোকন করা যাচ্ছে বিধায় এ দিবসটির বিরোধিতা সচেতন মহলের নিকট দাবি করছি।

কেননা আমরা কেউই চাই না আমাদের দেশের মানুষগুলি ইউরোপ-আমেরিকার মানবরুপি পশুর মতো হয়ে যাক। আমরা চাই সর্বদা ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকি।

এদিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস, রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি কোন দিবস না হলেও সামাজিকভাবে অতি প্রাচীন কাল থেকে এটি প্রতিষ্ঠিত একটি দিবস। এ দিবসটির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় এর বয়স সতের শত উনচল্লিশ বছর হলেও ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ নামে এর চর্চা শুরু হয় সাম্প্রতিক কালেই। দুই শত সত্তর সালের চৌদ্দই ফেব্রুয়ারির কথা। তখন রোমের সম্রাট ছিলেন ক্লডিয়াস। সে সময় ভ্যালেন্টাইন নামে একজন সাধু, তরুণ প্রেমিকদেরকে গোপন পরিণয় মন্ত্রে দীক্ষা দিত। এ অপরাধে সম্রাট ক্লডিয়াস সাধু ভ্যালেন্টাইনের শিরচ্ছেদ করেন। তার এ ভ্যালেন্টাইন নাম থেকেই এ দিনটির নাম করণ করা হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ যা আজকের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৯৩ইং সালে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ফেইসবুক সহ পুরো অনলাইন দুনিয়ায় ভালবাসা দিবস নিয়ে অনেক লেখা কন্টেন্ট, টিপস ইত্যাদি প্রচার শুরু হয়ে গেছে। গুগলে ভালবাসা দিবস নিয়ে সার্চ করলে টিপস পাওয়া যায়, তবে এর উৎপত্তি সংক্রান্ত তেমন তথ্য পাওয়া যায় নি। বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার সহযোগিতায় কিছুটা পেলেও পুরো ইতিহাসটি স্পষ্ট আকারে পাওয়া যায় ইসলামী একজন ভাল মানের লেখকের ব্লগে।

চাঁদপুরের আধুনিক তরুণ ইসলামী চিন্তাবিদ ও একটি জুমআ মসজিদের খতিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান সালেহীকে ভালবাসা দিবসের শরীয়াতে বৈধতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান দিবসটির সামাজিক বৈধতা থাকলেও ইসলামী শরীয়াতে এর কোন বৈধতা, বরং রীতিমত এটি ইসলামী শরীয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক।

তিনি এ দিবসটি সংস্কৃতির নেতিবাচক বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আর ভালবাসা এরই একটি অংশ। সে হিসেবে ভালবাসা শব্দটি কারো অপরিচিত নয়। উগ্রবাদী ও সমাজতান্ত্রিকবাদীরা ১৪ ফেব্রুয়ারীকে বিশ্ব ভালবাসা দিবসটি উদযাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য একজন নারী তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন তথা ইজ্জত স্বেচ্ছায় নষ্ট করা। একশ্রেণির উগ্রবাদী যুবক অপেক্ষমান থাকে কখন সেই দিনটি আসবে আর একজন অবলা নারীর সতিত্ব সে কেড়ে নিবে।

তিনি আরো বলেন এ দিবসটি তো ইসলামী সংস্কৃতি তো দুরের কথা এটি ইসলামের সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক বটে। আমরা যারা মুসলমান তাদের প্রতিটি ক্ষনেই ভালবাসার। সর্বোপরী এ দিবসটি ইহুদী খ্রীষ্টান ও রোমানদের এটি কখনো মুসলমানদের দিবস হতে পারে না, তাই এটি পালন করার কোনো বিষয় নয়।

লেখক: দেলোয়ার হোসাইন – নির্বাহী সম্পাদক, চাঁদপুর টাইমস।
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০১৯  

Share