Home / শীর্ষ সংবাদ / ভালোবাসার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড
ভালোবাসার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড

ভালোবাসার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পবিত্র ভালোবাসার জয়যাত্রা

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আজ, সব বিরোধিতা, সব সমালোচনা দূরে ঠেলে দেশে দেশে মানুষ বলে উঠবে, আর নয় মারামারি হানাহানি, আমরা একটি শুধু ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়ে তুলবো।

এদিনটিকে সারাবিশ্বের মানুষ ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বললেও বাঙালি প্রাণের ভাষায় মায়ের ভাষায় এ দিবসের নাম দিয়েছে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায়। দিবসটি উপলক্ষে বসে অগণিত মানুষের মিলনমেলা।

দিবসটি শুধু ভালোবাসার। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা সারা বছর অধীর আগ্রহে দিনটি আগমনের অপেক্ষায় থাকে। মনের মতো সেজেগুঁজে সবচেয়ে আপন মানুষটিকে আরও আপন করে পেতে এদিন সবার মনে জেগে ওঠে একটি নতুন টান। সেই টানে সাড়া দিয়ে দিনভর চলে তারুণ্যের জয়গান।

শুধু তরুণ-তরুণীরা কেনো, এখন প্রৌঢ়-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউই আর বসে থাকেন না। সবাই আপনজনদের সাথে ভালোাবাসার মুহূর্তগুলো বিনিময় করতে ব্যস্ত থাকে। ঢাবি-র টিএসসিতে প্রাণের বাঁধভাঙা জোয়ার যেনো সবার মনে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয়। এখানে ভালোবাসা দিবসে সবাই যেন হারিয়ে যেতে চায় শুধুই ভালোবাসাবাসিতে। কারণ জীবন তো অতি ছোট। এই ছোট্ট জীবনে মানুষকে ভালোবেসে মানুষের অন্তরে চিরদিনের স্থায়ী একটা আসন গড়ে নিতে চায় সবাই।

সেজন্যেই শিল্পীর উচ্চারণ :

“ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়

তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়।’

চার অক্ষরের একটি শব্দ, যার নাম ভালোবাসা। আর মানুষ যাকে ভালোবাসে সে হচ্ছে ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসার জন্যে, ভালোবাসার মানুষের জন্যে পৃথিবীতে মহান কতো কিছু সৃষ্টি হয়েছে আবার ধ্বংসও হয়েছে। সম্রাট শাহজাহান তার ভালোবাসার মানুষ মমতাজের স্মৃতিরক্ষার জন্যে গড়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত তাজমহল আর ভালোবাসার মানুষ হেলেনকে পাবার জন্যে ধ্বংস হয়েছিলো ট্রয় নগরী। শুধুমাত্র সৃষ্টি, ধ্বংস নয়- ভালোবাসার জন্যে মানুষকে খুনও হতে হয়।

এতো কিছু জানার পর তবুও মানুষ তার প্রিয়জনকে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা শুধু কিছুসংখ্যক নারী-পুরুষের মাঝে নির্ধারিত নয়। এ ভালোবাসা সর্বজনীন। যেমন- মায়ের ভালোবাসা, সন্তানের ভালোবাসা, পিতার, বোনের, ভাইয়ের, বন্ধুর ভালোবাসা। বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এ পৃথিবীতে যুগে যুগে যতই হত্যা, ধ্বংস ও এটমিক বোমার তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, তারপরও বিশ্বসভ্যতা এখনও টিকে আছে। এই টিকে থাকার প্রধান উপাদান হলো মানুষের প্রতি মানুষের মমতাবোধ, যার নাম ভালোবাসা। ভালোবাসাবোধই মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে যুগের পর যুগ ধরে।

কারণ, শুরুতেই একটি গানের অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছিলো- যেখানে গীতিকার উল্লেখ করেছেন, ভালোবাসা জীবনের চেয়েও বড়। আর সে ভালোবাসার মানুষের জন্যে হাজার বছরও বাঁচতে ইচ্ছে করে। কথাটি অমূলক নয়। কারণ, যদিও মানুষ জানে তার জীবন স্বল্প সময়ের, তবুও সে ভালোবাসে। আর ভালোবেসে সম্রাট শাহজাহান, লাইলী-মজনু, শিরী-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট তাদের কীর্তির জন্যে আজও মানুষের অন্তরে জাগরুক হয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বজনীন ভালোবাসার জন্যে মাদার তেরেসাসহ আরো অনেক মহান মানুষের নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই বিশ্বের সব মানুষের জন্যে তাদের অন্তরের ভালোবাসা, সুখ-শান্তি বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

ভালোবাসার এ মহান ত্যাগকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৪ ফেব্র“য়ারিকে সারা বিশ্বব্যাপী ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এই দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ কিংবা ‘পবিত্র ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

জানা যায়, অনেক দিন পূর্বে রোম নগরীতে ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামক এক যাজক পবিত্র ভালোবাসার বাণী নিয়ে সে দেশের মানুষদের কাছে গেলেন। তিনি প্রচার করেন যে, সংঘাত-সংঘর্ষ নয়, সব মানুষকে মহান ভালোবাসার পথে এগুতে হবে। তবেই দিশা হারানো মানুষ খুঁজে পাবে তার প্রাণের স্রষ্টাকে। আর পরস্পরকে ভালোবাসাই হবে মানুষের বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। তিনি প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে গোপনে বিয়ে পড়াতে লাগলেন। বহু ষড়যন্ত্রের শিকার রাজবন্দীকে জেল থেকে পালাতেও সাহায্য করতে লাগলেন। এসব অপরাধের জন্যে ‘ক্লডিয়াস’ ‘ভ্যালেন্টাইন’কে বন্দী করতে আদেশ করলেন। অবশেষে তাকে ধরে করে আনা হলো এবং জেলের অভ্যন্তরে বন্দী করে রাখা হলো।

কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বন্দী অবস্থায় জেলারের মেয়ের সঙ্গে পবিত্র ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে তাদের এ প্রেমের কথা জানাজানি হয় এবং সে কারণে তৎকালীন রাজশক্তি ভালোবাসার প্রতীক ভ্যালেন্টাইনকে ২৭০ সালের ১৪ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অত্যন্ত অমানবিকভাবে হত্যা করে। ফলে হাজার হাজার মানুষ নেমে এলো রাস্তায় এবং ভালোবাসার আইকন ভ্যালেন্টাইনকে ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’ আখ্যায়িত করে ওই দিনটিকে ভালোবাসার দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের ‘সম্রাট’ থেকে একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘মানুষ ঘৃণা করার অপরাধে কখনো কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি, অথচ মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে অতীতে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।’

কথাটি অত্যন্ত সত্যি, যার মধ্যে কোনোপ্রকার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যুগে যুগে মানুষকে ভালোবাসার জন্যে বলিদান করা হয়েছে। মানুষকে ভালোবাসাতে গিয়ে হাজারো মানুষ খুন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। কারণ, স্বার্থের এ পৃথিবীতে মানুষ নিজের স্বার্থে সমাজ, রাষ্ট্র, আইন সর্বোপরি প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসাকে ব্যবহার করে থাকে। যে কথাটি, আইনটি নিজের পক্ষে যায় সেটিই সঠিক। যা অন্যের পক্ষে তা’ মিথ্যা বলে ধারণা করা হয়। ফলে স্বার্থের ইন্দনে চাপা পড়ে যায় সত্যিকারের মনুষ্যত্ব, মানবতা, ভালোবাসা।

এছাড়াও ভালোবাসার এ পবিত্র দিবস প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, দেখা যায় সমাজ-সংসারে কিছুসংখ্যক মানুষ অপরের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে পরিশেষে প্রতারণা করে। ফলে যে মানুষটি খাঁটি মনে একজন মানুষকে তার মনের কুঠুরি থেকে দিয়েছিলো পবিত্র ভালোবাসার বিচ্ছুরণ, সে মানুষটি অকূলপাথারে পড়ে জীবনের প্রতি মায়া-মমতা ত্যাগ করে, কেউবা মনের জ্বালা-যন্ত্রণা সইতে না পেরে হয়তো করে আত্মহত্যা।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আহ্বান

১৪ ফেব্র“য়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে তাই আহ্বান থাকবে, হে দুনিয়ার মানুষেরা! তোমরা ভালোবাসো কিন্তু প্রতারণা করো না। তাহলে তোমরা হবে অভিশপ্ত। কারণ এ পৃথিবীতে প্রতারণা করে যে সুখ পেলে তার খেসারত দিতে হবে অনন্তের ওপারে, মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। একজন মানুষের “মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা সমান কথা”। তাই আমরা আজ এ ভালোবাসা দিবসে অঙ্গীকার করবো, বিশ্বের সব মানুষকে ভালোবাসবো অন্তরের অন্তস্থল থেকে কিন্তু প্রতারণা করবো না। কারণ, ভালোবাসা-ই মানুষ, সমাজ-সংসার ও একটি জাতির বেঁচে থাকার অন্যতম শক্তি।

মিজানুর রহমান রানা

|| আপডেট: ১২:৩১ অপরাহ্ন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, রোববার

এমআরআর