Home / বিশেষ সংবাদ / প্রযুক্তির অপব্যাবহারে বাড়ছে বিচ্ছেদ ভাঙছে সংসার
ভাঙছে সংসার
প্রতীকী ছবি

প্রযুক্তির অপব্যাবহারে বাড়ছে বিচ্ছেদ ভাঙছে সংসার

আধুনিকতার দাম্ভীকতা ও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমের অপব্যাবহারের কুফল দিনে দিনে তীব্র হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্য থেকে সম্পৃতি উঠে যাচ্ছে। তবে সব থেকে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সংসার ভাঙার করুন কাহিনীগুলো। বিচ্ছেদ বাড়ছে কখনো সংসারে কখনো সম্পর্কে।

প্রেমিক যুগল, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুত্ব, আত্বীয়তার সম্পর্কে অথবা ভাতৃত্যের সম্পর্কেও ভাঙন ধরছে। কেউ ভালোবেসে, কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। শুরু হয় একটি সুখী সংসারের ’পরশ পাথরের’ গল্প।

‌‌‌‌‌ ‌’ধন নয়, মান নয়, এইটুকু বাসা করেছিনু আশা’

প্রথমদিকে দাম্পত্য জীবনে বোঝাপড়াটা হয়তো হয়ে ওঠে’। কিন্তু বুকভরা আশা আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা দিচ্ছে না সুখপাখি। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সংসার।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংসারের বন্ধন দুর্বল হচ্ছে ক্রমেই। যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ভালো লাগা, ভালোবাসাও যাচ্ছে কমে। ফলে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। গত এক দশকে বদলে গেছে তালাকের ধরন। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। কিন্তু ’সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’ এই মিথ সময়ের ব্যবধানে ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখন তালাকের ঘটনায় নারীরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ৮০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটছে স্ত্রী কর্তৃক।

অতীতকালে সংসার ছিল কঠিন বাধনে বাধা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন ঠুনকো কাচের দেয়ালে পরিনত হয়েছে সেই বন্ধন। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই প্রায় অভিন্ন চিত্র। স্বপ্নগুলো সত্য হয়ে উঠতে না উঠতেই খানখান হয়ে যাচ্ছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুন আর সঙ্গীদের থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা বেড়েছে তিনগুন।সম্প্রতি বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

bou-marriage

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে এধরনের সামাজিক পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে বিবাহ নিবন্ধক, মনোবিজ্ঞানী এবং জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন হ্রাস, বহুগামিতা, বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, অতিমাত্রায় ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ, অর্থনৈতিকভাবে নারীদের শক্ত অবস্থান, পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ এবং আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় একজন নারী এখন তার পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা করতে পারছে। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেক নারী নিজের পেশা জীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ফলে নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি তালাক হচ্ছে ঢাকা সিটিতে। ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় তালাক হচ্ছে ১টি করে। ঢাকার অভিজাত অঞ্চলখ্যাত উত্তর সিটিতে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৭৫ ভাগ। দক্ষিণ সিটিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। দুই সিটিতে আপোস হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশের কম।

তালাকের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’। স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামী।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মানুষের নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ নষ্ট হওয়ার কারণে পরকীয়া, খুন ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আত্মীয়তার সর্ম্পক। অপসংস্কৃতি চর্চায় মানুষের চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্দি পাচ্ছে। ফলে স্বামী-স্ত্রীরা বিদ্যমান সর্ম্পকের বাইরে গিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে সর্ম্পক তৈরি করছে। ফলে সোনালী সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে।

এর থেকে বের হয়ে আসার উপায় সম্পর্কে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ শেখাতে হবে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মতে, সাধারণত উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে বিচ্ছেদ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন প্রবণতা অনেকটাই কম।’ বিচ্ছেদের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কেউ কারও কথা শুনতে চান না। তারা যে যার কথা মতো চলেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, নিজেদের অঢেল অর্থ সম্পদ রয়েছে, তাই বিচ্ছেদ হলে সমস্যা হবে না। আর নিম্নবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক থাকে বেশি।

বেশিরভাগ পরিবারের নারীরা চাহিদা অনুযায়ী অনেককিছুই পাননা, অভাব অনটন লেগেই থাকে। ফলে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হয়। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা লোকলজ্জায় ঘর ভাঙতে রাজি হন না।

বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ফারাহ দীবা বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মুখ্য কারণ হলো নারীর আর্থিক সক্ষমতা। দেখা যায়, কর্মজীবী নারীদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। আবার মাদকের প্রভাবেও বিয়ে বিচ্ছেদের মাত্রা এখন ভয়াবহ জানিয়ে তিনি বলেন, এটিও বিচ্ছেদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ।

বিবাহ বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে ফেসবুক বা মোবাইল কালচার বড় প্রভাব ফেলছে । বিশেষ করে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের মধ্যে নানা ধরনের আকাঙ্খা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখান থেকেই বাড়ছে অপ্রাপ্তিবোধ ও হতাশা। তিনি বলেন, একটা মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটা মানুষকে বিয়ে করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের গুণ যেমন আছে তেমনি দোষও থাকবে। দুটো মিলিয়েই মানুষ। সুতরাং পার্টনারের দোষ-গুণ দুটোই মেনে নিতে না পারলে সংসার টেকানো যাবে না।

বার্তা কক্ষ, ২৯ জানুয়ারি ২০২০