এক বছর আগে পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দর নগরী করাচিতে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নাকিবুল্লাহ মেহসুদ নামের এক তরুণ নিহত হন। এ ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ দাবি করে, পাকিস্তানি তালেবানের কট্টর সদস্য ছিলেন মেহসুদ। সন্ত্রাসীদের গোপন একটি আস্তানায় অভিযানের সময় মারা যান তিনি।
কিন্তু তার পরিবার, বন্ধু ও বেশকিছু মানবাধিকার সংস্থা পুলিশের এ দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা বলেছে, মেহসুদ ছিলেন নির্দোষ এক দোকানদার এবং উচ্চাভিলাষী মডেল। সরকার এ ঘটনায় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেয়। পুলিশের তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় কোনো ধরনের বন্দুকযুদ্ধ অথবা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কোনো আলামত পায়নি।
ভুয়া বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়ে মেহসুদকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় তদন্ত কমিটি। এ ধরনের অভিযোগ পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই উঠে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং তাদের বিচার এখনো চলছে।
অতীতেও এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উপেক্ষা করার নজির রয়েছে পাকিস্তানের। শাস্তির মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। কিন্তু মেহসুদের ঘটনাটি অন্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে; ওয়াজিরিস্তানের মাকিন শহরের একেবারে অপরিচিত একটি সংগঠন পশতুন তাহাফ্ফুজ ম্যুভমেন্ট (পশতুন সুরক্ষা আন্দোলন-পিটিএম) এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু করে। ফলে দেশটির সরকার এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হচ্ছে পশতুন। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য আফগান সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পশতুনদের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে ও নাগরিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী মনজুর পশতিন পিটিএম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পশতুনরা দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
টুইন টাওয়ারে ৯/১১’র হামলার পর মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে। পরে আফগান জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে এবং সীমান্তের কাছের পশতুন অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নেয়। ওই এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের উৎখাত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুরো মাত্রার সামরিক অভিযান চালায়।
তবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করার পরিবর্তে পাক সামরিক বাহিনী অভিযানে ওই এলাকার নির্দোষ মানুষকে শিকারে পরিণত করে। সেই সময় পাকিস্তানজুড়ে পশতুনদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়; যদিও পশতুনরাই সেখানে সন্ত্রাসবাদের শিকার।
ন্যায়বিচারের দাবিঅতীতের ভুল থেকে শিক্ষা
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানেও একই ধরনের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সেই সময়ের সর্ববৃহৎ জাতিগত গোষ্ঠী বাঙালিরা জেনারেল আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের উপেক্ষা, বঞ্চনা, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। বাঙালিদের বঞ্চনার অভিযোগ শোনা ও অবিচার মোকাবেলার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। ফলে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন বাঙালিরা; ভেঙে যায় পাকিস্তান, জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
প্রায় ৫০ বছর পরে এখন মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নেয়নি এবং একই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে তারা, যা ১৯৭০ সালের মতো পাকিস্তানের জন্য অনেক ব্যথা, রক্ত বন্যা ও অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
চলতি মাসেই পিটিএম তাদের প্রতিষ্ঠার এক বছর পালন করেছে। এখন পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্ব পশতুন জনগোষ্ঠীর বৈধ উদ্বেগ, তাদের দাবি-দাওয়া পাক সংবিধান অনুযায়ী ভালোভাবে মোকাবেলা করবে এবং এটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। শিগগিরই নিপীড়ন বন্ধ করে তাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
যদি তা না করা হয়, তাহলে ইতোমধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া একটি দেশের ভাঙনের জন্য অনুঘটক হতে পারে পিটিএম এবং পাকিস্তান আরো একটি জাতীয় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। (জাগো নিউজ)
২৮ জানুয়ারি,২০১৯