মো. কামাল হোসেন খান, মতলব (চাঁদপুর) : আপডেট: ১০:০৫ অপরাহ্ণ, ২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার
ভরা বর্ষা মৌসুমে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র খ্যাত চাঁদপুরের মতলবের ষাটনল মেঘনা নদী হতে চরআলেকজান্ডোর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা নদী ইলিশশূন্য। মতলবের মেঘনা-পদ্মা তীর ঘেঁষে মতলব উত্তর উপজেলার ১২-১৪টি জেলে পল্লীসহ উপজেলার ৫ হাজার ২শ’৫৩ জন জাটকা জেলেরা শূন্য হাতে ফিরছে নদী থেকে।
মতলবের পদ্মা-মেঘনায় ভরা মৌসুমেও খোঁজ মিলছে না চাঁদপুরের রূপালী ইলিশের। তাই জেলেরা অলস সময় পার করছে। আর এ কারণে উপজেলার জেলে পাড়া খ্যাত ষাটনল মালো পাড়া এখলাছপুর, দশানী, মোহনপুর, আমিরাবাদ, ছটাকী, দশানী,আমিরাবাদএ সব ইলিশ পল্লীর জেলেদের মুখে হাসি নেই। ইলিশের এ ভরা মৌসুমে দিন-রাত নদীতে জাল ফেলেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না ইলিশ। অভাব-অনটন ঘিরে রাখছে এসব পল্লীর জেলে বসতিদের। পুরো আষাঢ় ও শ্রাবণের এ ভরা বর্ষায় এক সময় মেঘনা-পদ্মা পাড়ে ছোটবড় একাধিক মাছঘাটে ইলিশ ধরার উৎসব চলত।
জেলে, দাদনদার, আড়তদার, দালাল, পাইকার আর ফরিয়াদের পদচারণায় প্রতিটি মাছঘাট সারাদিন থাকতো মুখরিত। এখন ওই ঘাটগুলোতে চলছে সুনসান নীরবতা। খাঁ খাঁ করছে প্রতিটি আড়তের মাছের ডালিগুলো। দু’চারজনকে অলস সময় কাটাতে দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয় না জেলে পল্লীর ঘরগুলোতে। দরিদ্রের নির্মম কশাঘাতে জেলে পরিবারগুলোর হাহাকার। ইলিশ আকাল সময় তিন মাস, মা ইলিশ নিধন প্রতিরোধ ও জাটকা সংরক্ষণে সরকারের বেঁধে দেয়া সাত মাস সময় বেকার থাকায় জেলেরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। ইলিশশূন্য নদী ভাগ্যদেবীর নির্মমতা আর দাদন ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত ওঠায় দু’মুঠো অন্নের নিশ্চয়তা নেই এসব ভাগ্যাহত জেলের।
দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য আর এনজিও কর্মীদের ক্ষুদ্র ঋণ ও সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিদ্বন্ব্দ্বিতার জাঁতাকলে জেলেদের সর্বস মালিকস্বত্ব নিয়ে নেয় এনজিও। ঋণের হালকরণ শুরু হয় এ মাসেই। বিভিন্ন এনজির তথ্য মতে, ঋণগ্রহীতা প্রায় পাঁচ শতাধিক জেলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ ঢাকা-চট্রগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে পালিয়ে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদিকে জেলেরা নিজেদের সব খুইয়ে চড়া সুদে মহাজন ও এনজিও দের কাছ থেকে টাকা এনে নদীতে নেমেছে। সারাদিন রাত নদীতে কাটিয়ে মাছ না পেয়ে জেলেরা হতাশ হয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছে। তারা ঋণের টাকা পরিশোদ করবে নাকি? অভাব-অনটন গুছাবে। এ মানষিক চিন্তাই কাছ করছে জেলেদের মাথায়। এদিকে নদীতে মাছ না পাওয়ায় সুদের টাকা ও এনজিওদের কিস্তি চালাতে পারছে না।
প্রতিনিয়ত বসত-ঘরের জিনিস পত্র বিক্রি করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করছে। আবার কেউ কেউ পরিশোধ করতে না পেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে জেলেদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, এ ভরা মৌসুমে নদীতে মাছ না পাওয়ায় তারা শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছে। সারা রাতভর নদীতে জাল ফেলে যাও পায় তাতে ইঞ্জিন চালিত নৌকার তেলের টাকাই উঠেনা। এভাবে চলতে থাকলে তাদের আত্মহত্যা ছাড়া তাদের কোন পথ খোলা থাকবে না বলে কয়েকজন জেলে পরিবার জানান। যেখানে ভরা মৌসুমে ২০-৫০ কেজি ইলিশ নদী থেকে ধরে থাকে সেখানে বর্তমানে জেলেরা ১-২ হালি ছোট সাইজের টেম্পু ইলিশ পাচ্ছে। ফলে চরম হতাশা হয়ে পড়ছে জেলে পরিবারগুলো।
২৫-৩০ বছর ধরে মেঘনা নদীর বুকে মাছ ধরছেন এখলাছপুরের হাশিমপুর গ্রামের আঃ জব্বর বেপারী (৫০), নুরুল ইসলাম (৫২) তারা বলেন, ইলিশ শূন্য হইয়া গেছে নদী। ইলিশের এ ভরা মৌসুমে দিন-রাত নদীতে জাল ফেলেও আমগো জালে ধরা পড়ছে না ইলিশ। যাও ধরা পড়ছে তা খাওয়া তো দূরের কথা বিক্রি করে সংসার চালানো কষ্ট। এনজিওর টাকায় আমগো নাও জালের উন্নত হয়েছে। অহন নদীত মাছ না পাওয়ায় কিস্তি দিতে পারিনা। পাড়ে এনজিও স্যারের বইয়া তাহে কিস্তি নেওয়ার জন্য। মাছ বাদেই নদী থেইক্যা আইছি। অহন আমনেরাই কন? কিস্তি কইতে দিমু। অফিস টাকা পাইবে, না দিয়া উপায় নাই। তাই ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি কইরা কিস্তি দেই। আবার অনেক সময় এনজিও কর্মকর্তারা কিস্তি নিতে আসার কথা শুনে পালিয়েও থাকতে হয়।
একই কথা জানালেন ষাটনল জেলে পল্লীর ওমর আলী ও ইমাম হোসেন, একে তো মা ইলিশ নিধন ও জাটকা আহরণে সরকারি অবরোধে বছরের বড় এক সময় বেকার দিন যায়। তার ওপর মৌসুমে ইলিশের দেখা না পাওয়ায়, পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত তুলে দিতে হিমশিম খাই। আর এ কারণে উপজেলার জেলে পাড়া খ্যাত ষাটনল মালো পাড়া এখলাছপুর, দশানী, মোহনপুর, আমিরাবাদ, ছটাকী, এ সব ইলিশ পল্লীর জেলেদের মুখে হাসি নেই। উপজেলা ষাটনল মালোপাড়া বাবুর বাজার, এখলাছুপুর, আমিরাবাদ, দশানী,মোহনপুর ও চরকাশিম বোরচরের রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক ইলিশ ব্যবসায়ী। বাজারে ইলিশ না আসায় তাদেরও দুঃসময় যাচ্ছে বলে একাধিক ইলিশ ব্যবসায়ীরা জানান।
মতলবের মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছের এই আকাল হওয়ায় জেলেরা নদীতে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে জেলে পাড়ায় চলছে হাহাকার।
উপজেলার এখলাছপুরের হাশিমপুরের জেলে পল্লীর গৃহবধূ নখাদিজা বেগম জানান, নদীতে মাছ না থাকায় তার স্বামী ইব্রাহীম খলিল শ্রমিকের কাজ করতে চিটাগাং চলে গেছে। ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছে তাদের দিন। এমন চিত্র এখন মতলব উত্তর উপজেলার প্রতিটি জেলে পল্লীতে।
জেলেদের দুর্দশা ও ভর মৌসুমে ইলিশের দেখা না পাওয়ার বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, উপজেলায় ৫ হাজার ২শ’৫৩ জন জাটকা জেলে তালিকাভুক্ত জেলে রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচ হাজার ৪শ’৫৪জন জেলেকে অভয়াশ্রম সময়টুকুতে সরকারি ৪০ কেজি করে চালের সহযোগিতা পায়। তাছাড়া এদের মধ্যে আবার ২৯০ জন জেলেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য মেঘনা নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকার (অভয়াশ্রমের) সময় বিভিন্ন উপকরন বিতরণ করা য়েছে। নদীতে মাছ নাই, বাকিরা কষ্টে থাকার কথাই বলবে। মাছ না পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃৃতিক কারণে হতে পারে বলে তিনি জানান।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি