দেশের ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, ঋণ কেলেঙ্কারির নতুন-নতুন ঘটনা ঘটছে। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লুট, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে এটিএম কার্ড জালিয়াতি। এসব কেলেঙ্কারি-জালিয়াতি ছাপিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ লুটের এমন ঘটনা ঘটেনি। এতে দেশের আর্থিক খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, ব্যাংক খাতের অতীতের কেলেঙ্কারি মূল হোতারা প্রভাবশালী হওয়ায় বারবার পার পেয়ে গেছেন। প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা তো হয়নি, উল্টো ঘটনাগুলো নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। যা দেশের আর্থিক খাতের অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য দুষ্কৃতকারীদের জালিয়াতির ঘটনা ঘটাতে উস্কে দিয়েছে।
যে কারণে এটিএম কার্ড জালিয়াতি ঘটনা ঘটানোর সাহস পেয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রিজার্ভের অর্থ চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে ১৩ মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ঘটনাটা এক মাস আগে ঘটলেও তা আমাকে না জানানোর যে ধৃষ্টতা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখিয়েছে ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে ভীষণ অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, সে জন্য তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অবশ্য অর্থমন্ত্রীর এমন হুঁশিয়ারি কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। কারণ এর আগে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে অর্থমন্ত্রী গত বছরের ৮ জুলাই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ব্যাংকটিতে হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তার ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণেই বেসিক ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে। তার ব্যাংক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না।’ ‘যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হবে।’―এমন মন্তব্যও করেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এরপর বাস্তবতা দেখা যায় ভিন্ন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে।
তবে অর্থমন্ত্রী যাকে জালিয়াতির মূল হোতা হিসেবে অখ্যায়িত করেছিলেন সেই আবদুল হাই বাচ্চুর কোনো দায় খুঁজে পায়নি দুদকের তদন্ত দল। অবশ্য এর আগে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা দলের লোক।’
এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি নিয়ে অর্থমন্ত্রী কী ব্যবস্থা নেন এবং পরবর্তীতে কী মন্তব্য করেন দেখা বিষয়। এখন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের যতগুলো কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়েছে, তার মধ্যে সব থেকে বড় ঘটনা হল-মার্ক কেলেঙ্কারির। এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করে বসেন, ‘ব্যাংকিং খাতে আমরা ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিই। এর মধ্যে মাত্র তিন বা চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এটা কোনো বড় অঙ্কের অর্থ নয়। এ নিয়ে হইচই করারও কিছু নেই। সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণা করে দেশের ক্ষতি করছে। এমন ভাব যেন দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ধসে গেছে।’ অর্থমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এদিকে দেশের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে লক্ষাধিক বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করা হলেও তারও কোনো বিচার হয়নি। উল্টো শেয়ারবাজার নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন অর্থমন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলরা।
অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারকে ‘ফকটা বাজার’, ‘জুয়ার দান’―এমন মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। ফলে শেয়ারবাজারে চরম আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। যে কারণে ২০১০ সালের মহা ধসের পর শেয়ারবাজার এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এভাবে দেশের আর্থিক খাতে একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়ম সংগঠিত হওয়া এবং জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় আর্থিক খাতে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সঠিক তদন্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা নাহলে মারাত্মক সংকটে পড়ে যাবে দেশের অর্থনীতি, এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঘটা কেলেঙ্কারি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেঙ্কারি একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা বিরল ঘটনা। এর আগে কোনো দেশের রিজার্ভ নিয়ে এমন কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেনি। তাই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে।
সেই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা এবং এটিএম কার্ড জালিয়াতিসহ বাণিজ্যক ব্যাংকে ঘটে যাওয়া ঘটনা এক বিষয় না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিষয় অভ্যন্তরীণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা অন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত ঘটনা স্পষ্ট হবে না। তবে এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন এমন সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ কোন প্রজেক্ট থেকে, কোন কোড ব্যবহার করে টাকা নেওয়া যাবে তা বাইরের মানুষের জানার কথা না।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা এবং এর আগে অভ্যন্তরীণ (বাণিজ্যিক ব্যাংকের জালিয়াতি) ব্যাংক খাতের ঘটনায় দেশের আর্থিক খাতে এক ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায়নি। আগে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে চরম নৈরাজ্য চলছে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে নিশ্চয়তা বোধ করতে পারছে না। এ ধরনের নৈরাজ্যের কারণ হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে যেভাবে টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাতে আমার সন্দেহ হয় এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছে। তা নাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এর আগে আমি কখনো শুনিনি কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে যেসব জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়নি। আর বিচার না হওয়ার কারণে একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে প্রকৃত জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংক খাতে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কোনোটিই দেশের ব্যাংক খাতের জন্য ইতিবাচক বিষয় না। ঘটনাগুলো নিশ্চিত করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি অবশ্যই বাড়াতে হবে। এমন ঘটনা বারবার ঘটলে ব্যাংক খাতে মারাত্মক আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রকৃত জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত তা বের করে আনতে হবে। সেই সঙ্গে তদন্ত রিপোর্ট সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কারণে ব্যাংক খাতে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে দোষীদের অবশ্যই বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর বিচার হবে।” কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল তার কোনো বিচার হয়নি।
এভাবে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া জালিয়াতির ঘটনার প্রকৃত অপরাধীদের বিচার না হওয়ার কারণে দেশের অর্থিক খাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে তা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এ টাকা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, না কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত তা এখন নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছেন এমন সন্দেহ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটায় সমগ্র আর্থিক খাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
শেয়ারবাজারের দিকে তাকালে দেখা যাবে ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের তেমন আস্থা নেই। এ ধরনের অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট দূর করতে অপরাধের সঙ্গে জড়িত মূল ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মূল ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে বিচার করলে হবে না।’ তবে ভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি হওয়া “সাপেবর হবে”। এই দুর্ঘটনা ঘটার কারণে সবাই সতর্ক হবে। নিরাপত্তা জোরদার হবে। যার সুফল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।’ “রিজার্ভের টাকা চুরি হওয়ায় আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে না”― এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বুঝতে হবে কতগুলো টাকা চুরি হয়ে গেছে। আজ যদি সবার টাকা নিয়ে যেত, যদি ২৮ বিলিয়ন (২ হাজার ৮০০ কোটি) ডলার মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলারই নিয়ে যেত, তাহলে বুঝতাম আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এখন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। এমনও হতে পারে এখান থেকে কেউ কোড দিয়ে দিয়েছে।’
সূত্র : দ্য রিপোর্ট
চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক ||আপডেট: ১০:১২ অপরাহ্ন, ১৪ মার্চ ২০১৬, সোমবার
এমআরআর