অর্থনীতি

লুটপাট চলছে,ব্যাংকের শ্বশুরবাড়ি শাখায়!

ব্যাংক পরিচালক বলে কথা। ক্ষমতা আছে, তাই যেখানে ইচ্ছে সেখানেই ব্যাংকের শাখা খুলতে পারবেন। ঘটেছেও তাই। সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন পরিচালক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এভাবে শাখা খুলতে গিয়ে নিজের বাড়ি ছাড়াও শ্বশুরবাড়ির এলাকায়ও শাখা খুলেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সক্ষমতা যাচাইয়ের ধার-ধারেননি। অগত্যা যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ ধরনের বেশিরভাগ শাখা এখন পাততাড়ি গোটানোর অবস্থায় চলে এসেছে। অর্থাৎ লাভ তো দূরের কথা লোকসানের ঘানি টানতে টানতে বন্ধ করে দেয়ার অবস্থা।

এদিকে কয়েকজন পরিচালক এ ধরনের লোকসানি শাখার জন্ম দেয়া ছাড়াও নিজেরা আবার জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছেন। নামে-বেনামে নিজস্ব লোকজন দিয়ে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি। রাষ্ট্রায়ত্ত বিডিবিএল ও রূপালী ব্যাংকে এ ধরনের প্রায় ২৪টি শাখা খোলার তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া সরকারি অন্যান্য ব্যাংক পরিচালকদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, অনুৎপাদনশীল বা কম জনসংখ্যাবেষ্টিত জায়গায় খোলা শাখা দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছে। অন্যতম কারণ কয়েকটি শাখায় ব্যাপক জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া ভালো কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠা এবং অপেক্ষাকৃত কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা না হওয়ায় বেশ কিছু শাখা প্রতিষ্ঠার ২ থেকে ৩ বছরেও লাভের মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, একটি নতুন শাখা খোলার আগে পর্যালোচনা করার বিধান রয়েছে। কত দিনে শাখাটি লাভজনক করা যাবে, কোন ধরনের এলাকায় শাখা খোলা যাবে এবং এভাবে শাখা খোলার পর যদি লোকসানে পড়ে তাহলে তো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠতে পারে।

সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিদের সুপারিশে খোলা শাখার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ে কোনো ধরনের শিথিলতা আছে কিনা তা বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও খতিয়ে দেখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র জানায়, বিডিবিএলের পরিচালকদের নেয়া বেশিরভাগ শাখাই লোকসানে। শুধু তাই নয়, কয়েকটি শাখায় ব্যাপক লুটপাট করা হয়েছে। একদিকে নিজের শাখা, অন্যদিকে নিজস্ব লোকজন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের কোনো কোনো শাখায় সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিডিবিএল পরিচালকদের নেয়া শাখার সংখ্যা ৮টি। এর মধ্যে বি-বাড়িয়ায় ‘আশুগঞ্জ শাখা’ খুলেছেন সাবেক পরিচালক ইসহাক ভূঁইয়া। তিনিই প্রথম উপজেলা পর্যায়ে শাখা খোলার প্রচলন করেন। শাখাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিয়মে ঠাসা। যে ভবনে শাখা অফিস সেই ভবনেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। ওই পরিচালকের যোগসাজশে শাখা অফিসের ভাড়া অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে। মাত্র ৬ থেকে ৮ টাকা প্রতিবর্গ ফুট জায়গার ভাড়া নেয়া হয়েছে ৩০ টাকা দরে।

এছাড়া প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবে অনেক ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখা গেছে, বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখায় গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়াতি করা হয়েছে। প্রায় ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন ও একটি বন্ধ রয়েছে। প্রায় ১১ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পরিচালকের কাছের লোকেরা। সে কারণে ৭৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে এই শাখায়। শাখাটির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন হচ্ছে- বিডিবিএলের আশুগঞ্জ শাখা হুমকিতে রয়েছে।

একইভাবে বিডিবিএলের সাবেক পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম দুটি শাখা খুলেছেন। একটি নিজের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায়। অপরটি শ্বশুর বাড়ি মানিকগঞ্জের মহাদেবপুর। এর মধ্যে সাটুরিয়া শাখায় খেলাপি ঋণ ২৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। নানা অনিয়মের কারণে শাখাটি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

এই প্রসঙ্গে আবদুস সালামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বিডিবিএলের বর্তমান পরিচালক সৈয়দ এপতার হোসেন পিয়ার সিলেটে খুলেছেন ‘ওসমানী নগর শাখা’। বিভিন্ন সময় অনিয়মের কারণে শাখাটি লোকসানে পড়েছে। বর্তমানে শাখাটিতে খেলাপি ঋণ ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বর্তমান পরিচালক সৈয়দ এপতার হোসেন পিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করে পরিচয় জানার পর আর কথা বলেননি।

সাবেক পরিচালক রুস্তম আলী নীলফামারীতে খুলেছেন ‘কাজিরহাট শাখা’। শাখাটি ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে লোকসানে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রুস্তম আলী বলেন, শাখাটি খোলা হয়েছে মাত্র এক বছর। এরই মধ্যে ১৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ, নিঃসন্দেহে এটা অ্যালার্মিং। তিনি বলেন, হয় তো ঋণ বিতরণে কোনো ভুল ছিল। সে কারণে এত খেলাপি।

বগুড়ায় ‘মোকামতলা শাখা’ খুলেছেন ব্যাংকের সাবেক এমডি। শাখাটি ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে লোকসানে পড়েছে।

বি-বাড়িয়ায় নবীনগর শাখা খুলেছেন সাবেক পরিচালক কাজী মোর্শেদ হোসেন কামাল। ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে শাখাটি লোকসানে রয়েছে। একইভাবে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে লোকসানে পড়েছে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর শাখা। শাখাটি খুলেছেন বিডিবিএলের সাবেক পরিচালক ও আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান হুমায়ূন।

সার্বিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বিডিবিএলের বর্তমান চেয়ারম্যান ইয়াছিন আলী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সব শাখা খোলা হয়েছে। এখানে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। এসব শাখায় কয়েকজন পরিচালকের ব্যাপক অনিয়মের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।

এছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের পরিচালকরা প্রায় ১৬টি শাখা খুলেছেন। এখন পর্যন্ত একটি শাখাও লাভের মুখ দেখেনি। এর মধ্যে শুধু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও এমডি ভাগাভাগি করে ১৫টি শাখা খুলেছেন। বাকি ১টি শাখা খুলেছেন ব্যাংকের অপর পরিচালক।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমদ আল কবির গত কয়েক বছরে নিজের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকায় ৮টি শাখা খুলেছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সিলেটের জকিগঞ্জে নিজ বাড়ির দরজায় কালিগঞ্জ শাখাটি খোলা হয়েছে। একইভাবে মৌলভীবাজার সদরে শ্বশুর বাড়ির কাছাকাছি খোলা হয়েছে গোবিন্দপুর শাখা। বাবু বাজার শাখাটি খোলা হয়েছে মৌলভীবাজারের জকিগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায়। জঙ্গলের মধ্যে গড়ে ওঠা শাখাটি কখনও লাভে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জকিগঞ্জে একটি শাখা রয়েছে। তার ওপর আরও একটি শাখা পাহাড়ের মধ্যে গড়ে তোলার দরকার ছিল না। শাখাটি সাবেক চেয়ারম্যানের স্বার্থে খোলা হয়েছে, যা কোনো দিন লাভের মুখ দেখবে না। একইভাবে রাজাগঞ্জ শাখা ও কানাইঘাট শাখা খোলা হয়েছে সিলেটের কানাইঘাটে। পাশাপাশি দুটি শাখার দরকার ছিল না বলে মনে করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। শ্বশুর বাড়ির পাশে আরও একটি শাখা খোলা হয়েছে। এটি হল কুলাউড়া শাখা।

এছাড়া মদিনা মার্কেট শাখা খোলা হয়েছে সিলেটের জালালাবাদে। এর বাইরে দেলিয়াই বাজার শাখা উদ্বোধন করেন রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমদ আল কবির। সবক’টি শাখা এখন লোকসানে।

রূপালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ব্যারিস্টার জাকির আহমেদ নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ ভবনের সামনে শাখা খুলেছেন। এমনকি শাখার নামের সঙ্গে নিজের নামও জুড়ে দিয়েছেন। বি-বাড়িয়ায় নিজের বাড়ির দরজায় খোলা শাখার এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি চায়ের দোকানও নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। নির্জন এলাকায় গড়ে ওঠা শাখাটির লোকসানের ঘানি টানছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিনের নিজের বাড়ি ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকায় খোলা হয়েছে আরও ৭টি শাখা। এগুলো হল- কাওরিয়া বাজার শাখা, মুলাদী বন্দর শাখা, মঠবাড়িয়া শাখা, মেহেন্দীগঞ্জ শাখা, ভাণ্ডারিয়া শাখা, পুটিয়াখালি বন্দর শাখা ও ইলিশা জংশন শাখা। এর একটি শাখাও লাভের মুখ দেখেনি।

সাবেক পরিচালক ব্যারিস্টার জাকির আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, পরিচালক বললেই শাখা খুলতে হবে, সেটার পক্ষে আমি নই। যদি ব্যবসায়িক স্বার্থ ও জনগণের উপকারে আসে সে বিবেচনায় শাখা খোলা যেতে পারে। সূত্র-যুগান্তর

নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়০৮:৩৫ পি.এম, ০৪ এপ্রিল ২০১৭,মঙ্গলবার
ইব্রাহীম জুয়েল

Share