জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় কমে আসে অর্থনৈতিক বৈষম্য

ইসলাম আসার আগে আরবের পুঁজিপতিরা নিজেদের ইচ্ছামতো অর্থনৈতিক নিয়ম চালু করেছিল। ফলে সেখানে দৃশ্যমান সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল। এই বৈষম্য দূরীকরণে কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন বিধান দেওয়া হয়েছে। এসব বিধানের বাস্তবিক প্রয়োগে সেখানে গড়ে উঠেছিল একটি বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ।

নিম্নে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হলো—

উত্তরাধিকার সম্পত্তির যথাযথ বণ্টন : ইসলামী আইনশাস্ত্রের অন্যতম একটি বিষয় হলো উত্তরাধিকার সম্পত্তির বিধান। মৃত ব্যক্তির নির্ধারিত ওয়ারিশদের মধ্যে নির্ধারিত পরিমাণ যথাযথ পন্থায় এবং যথাযথ সময়ে পৌঁছে দিলে যেকোনো পরিবারে ও সমাজে দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে আসে। এ বিষয়ে সুরা নিসার ১১, ১২ ও ১৭৬ আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। কিন্তু এ দেশের মুসলমানদের অনেকের মধ্যে ইসলামী বিধান মতে উত্তরাধিকার বণ্টন হয় না।

জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা : জাকাত ইসলামী অর্থনীতির মেরুদণ্ড ও চালিকাশক্তি। জাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম উৎস। এর অন্যতম হলো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের অভাবী, কর্মক্ষম, গরিব, মিসকিন, এতিম, বিধবাসহ অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা। জাকাতের অর্থ তা গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে তাদের পুঁজি সমবায়ের মাধ্যমে একত্র করে তা দিয়ে নানা ধরনের মিল, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা বেকাররা স্বাবলম্বী হতে পারে—এ পরিমাণ জাকাতের অর্থ প্রদানেরও সুযোগ আছে। ইসলামে জাকাত তোলার জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার বিধান আছে, যাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘আমিল’ বলা হয়। এর মাধ্যমেও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

মজুদদারি বন্ধ করা : দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির কপট উদ্দেশ্যে সম্পদ মজুদ করা হারাম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মজুদদার মহাপাপী।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৬০৫)

করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ দেয়া : মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সে ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশি প্রদান করবেন? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই রুজি সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন। আর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৪৫) ঋণ ও ধারদেনা অর্থনৈতিক জীবনের অংশ। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোরআনে বর্ণিত করজে হাসান একটি উত্তম ফর্মুলা হতে পারে।

অপচয় বন্ধ করা : আল্লাহ বলেন,‘নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ।’(বনু ইসরাইল, আয়াত : ২৭) অথচ বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণি প্রতিদিন যে খাবারের অপচয় করে, তা দিয়ে দেশের বহু না খেয়ে থাকা মানুষের পেট ভরানো সম্ভব। UNEP ২০২১ সালে যে Food Waste Index প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে,বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ছয় লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়।

সুদি অর্থনীতি : সুদি অর্থায়ন ও বিনিয়োগ ব্যবস্থায় পুঁজির মালিক বা ব্যাংক উৎপাদনের কোনো ঝুঁকি বহন করে না এবং সব ঝুঁকি কার্যত উদ্যোক্তার ঘাড়ে চাপে। ফলে নতুন উদ্যোক্তরা শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বিরাজমান শিল্পের মধ্যে অনেক সুদের অত্যাচার সইতে পারে না।

অন্যদিকে সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে। এভাবে সুদের হার কমে শূন্য হলে বিনিয়োগ সর্বাধিক হবে। সুতরাং সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কম হয়, বিশেষ করে সুদ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করে। সুদ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। সুদের হার উৎপাদনকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে দেয় না।

নৈতিক পুনর্গঠন : ইসলামী অর্থনীতির পূর্ণ সুফল পেতে সাধারণ মানুষের নৈতিক মানদণ্ডও উন্নত করা প্রয়োজন। নৈতিক পুনর্গঠন দ্বারা উদ্দেশ্য মানুষের ভেতর এতটুকু আল্লাহভীতি জাগ্রত করা, যেন সে তার ওপর অর্পিত আর্থিক দায়িত্ব পালন করে। পাশাপাশি সব ধরনের আর্থিক অসততা থেকে বেঁচে থাকে। কেননা এর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার গভীর সংযোগ আছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পথ করে দেন এবং তাকে জীবিকা প্রদান করেন ধারণাতীত উৎস থেকে।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ২-৩)

চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
১১ নভেম্বর ২০২৪
এজি

Share