বৈশাখ ফিরে আসে বার বার, ফিরেনা সেই শৈশবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস

প্রতি বছর যতই বৈশাখ ফিরে আসুক না কেনো, শৈশবে বৈশাখের আনন্দের মতো কি সে আনন্দ হয় কখনো। এবারের বৈশাখের একাল সেকাল নিয়ে কথা বলেছেন চাঁদপুরের স্বণামধন্য চিকিৎক চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ সুজাউদৌলা রুবেল। তাকে নিয়ে লিখেছেন গীতিকার ও লেখক : কবির হোসেন মিজি।

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা / অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। পুরনো এই কবিতার রেশ ধরেই সকল না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে সূচি করে তুলতেই আবারো সকলের মাঝে ফিরে এসেছে পহেলা বৈশাখ।

বাংলা সনের ১৪২৮ বঙ্গাব্দকে বিদায় জানিয়ে সকলে আজ ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানিয়ে নববর্ষকে বরণ করতে ব্যস্ত। আজ থেকে শুরু হলো নতুন বাংলা সাল ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। শুভ নববর্ষ।

নতুন বছরের প্রথম দিনটি চিরায়ত আনন্দ-উদ্দীপনা আর বর্ণাঢ্য উৎসবেরর মধ্য দিয়ে হাজির হলো প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। নতুন স্বপ্ন, উদ্যম আর প্রত্যাশার আবির ছড়ানো বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ।

বিগত বছর গুলোতে নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর বর্ণিল আয়োজনের মধ্যদিয়ে সারাদেশে একযোগে পহেলা বৈশাখ পালন করা হলেও বিগত দুটি বছর করোনা মহামারি এবং পবিত্র মাহে রমজানে পহেলা বৈশাখের সে বর্ণিল আয়োজন হয়ে উঠেনি। তবে বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ঘরোয়া আয়োজন কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের ছোট খাটো আয়োজনের মধ্যদিয়ে বছরের প্রথম দিনের সূচনা করছেন বাঙালী জাতি। কেউবা আবার বছরের প্রথম প্রহরে পাঞ্জাবি-শাড়ি পড়ে স্বজনদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন বৈশাখী মেলা বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

অনেকে আবার মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তায় পরিচিতজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জার, ইমুতে মেসেজের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কেউ কেউ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ভাষায়’ এসো হে বৈশাখ,এসো এসো। এমন অনুভূতিতে গ্রীষ্মের দাবদাহ এড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঠ-ঘাট, পথে-প্রান্তরে আজ বৈশাখের প্রহরে ঢল নামবে লাখো উচ্ছৃসিত জনতার।

তবে আমাদের শৈশবে বৈশাখের যে আনন্দ উচ্ছাস ছিলো। সে আনন্দ এখন আর নেই। কালের বিবর্তনে বাংলার সংস্কৃতির অনেক ঐতিহ্য ই হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যেকোন চিকিৎসক সারাদিন ব্যস্ত থাকেন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে। কিন্তু এত ব্যস্ততার মাঝেও পহেলা বৈশাখের দিন কেমন কাটান একজন চিকিৎসক সেই বাংলার ঐতিহ্যের কথা জানবো আজ । বৈশাখের একাল সেকাল নিয়ে কথা হয়েছে চাঁদপুরের অতি পরিচিত মুখ স্বনামধন্য চিকিৎসক, চাঁদপুর আড়াই,শ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেলের সাথে। ছেলেবেলায় যার বৈশাখ কেটেছে বৈশাখী মেলায় ঘুরে ফিরে বাঁশি আর ঢোল, নাগর দোলা, মাটির পুতুল, গরু আর ঘোরা কিনে। নববর্ষের প্রথম প্রহরে পান্তা-ইলিশ আর হালখাতার মিষ্টি খাওয়ার আনন্দে, চারদিকে হৈ ছৈ ভ্রমনে অনেক আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যদিয়ে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে করেছেন নববর্ষকে বরণ। বৈশাখের সেই দিন গুলোই ছিলো অন্যরকম। নারকেল পাতা ও বাঁশের বাঁশির পে পো শব্দ, রঙিন বেলুন উড়িয়ে ঝিকিমিকি জড়োয়ার রঙিন রঙ গায়ে মেখে হারিয়েছেন বৈশাখের মিলন মেলায়। দিন যায়, দিন আসে। বছরের পর বছর নতুন রূপে ফিরে আসে বৈশাখ। ফিরে আসেনি সেই ছেলেবেলার বৈশাখের আনন্দ – অনুভূতি।

বৈশাখ নিয়ে তার ছেলেবেলার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের শৈশবে বৈশাখে যে আনন্দ- অনুভূতি ছিলো। তার কিছুই এখন তেমন নেই। কালের বির্বতনে এখন দিন দিন সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন হচ্ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার কৃষ্টি কালচারের পুরনো ঐতিহ্য। সেই শৈশবের পহেলা বৈশাখের আনন্দ আর বর্তমান সময়ের আনন্দ তো অনেক, অনেক তফাৎ খুঁজে পাই। তখন বৈশাখ এলেই মন থেকেই মনের মধ্যে অনেক আনন্দ সৃষ্টি হতো। আর এখন শত আনন্দ উল্লাস করেও মনে তেমন আনন্দের সৃষ্টি হয়নি। ছোট বেলার বৈশাখের সেই আনন্দের তৃপ্তি পাওয়া যায়নি।

ছোটবেলায় যখন বৈশাখ আসতো, তখন খেলার সাথীদের নিয়ে বৈশাখের বিভিন্ন মেলায় ঘুরে ঘুরে সময় কাটাতাম এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার জিলাপি মিষ্টি খাওয়া হতো। আমাদের সময়ে যে আনন্দ ছিলো, এখন সে আনন্দ ঐতিহ্য বর্তমানে তেমন কিছুই নেই। আমি মনে করি আমাদের সময়ে বৈশাখে শৈশবে আমরা যে আনন্দ উল্লাস করেছি নতুন প্রজন্ম এখন তার কিছুই করতে পারেনি। বর্তমানে ডিজিটাল ইন্টারনেটের যুগে বৈশাখের সেই হারানো দিনের ঐতিহ্য অনেকেটাই হারিয়ে গেছে। যান্ত্রিক জীবন এবং ডিজিটাল ইন্টারনেটের যুগে সবাই এখন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। নতুন প্রজন্ম আমাদের মতো সেকালের সেই আনন্দ পাবে কোথায়।

কলেজ জীবনে পহেলা বৈশাখের দিন গুলো আপনার কেমন কেটেছে এমন প্রশ্নের জবাবে, ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, কলেজ জীবনেও পহেলা বৈশাখে আমরা বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে পান্তা-ইলিশ খেতাম। নতুন পাঞ্জাবী পড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।একই সাথে বৈশাখের দিনে বরিশালের কীর্তনখোলা ঘুরতে যাওয়া হতো। এছাড়া মেডিকেল কলেজের সকল স্টুডেন্টরা মিলে গানের আড্ডা জমিয়ে বৈশাখে অনেক আনন্দ উল্লাস করে সময় পার করেছি। ছোটবেলার বৈশাখ এবং কলেজ জীবনের বৈশাখের মাঝে বর্তমান সময়ের বৈশাখের আনন্দ অনেক তফাৎ খুঁজে পাই। সেই সোনালী দিন গুলো এখন শুধুই অতীত স্মৃতি হয়ে জীবনের পাতা থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, চাকরি জীবনে এসেও বর্তমান সময়ে পহেলা বৈশাখ এলেই আমরা সকল চিকিৎসকরা একত্রে মিলিত হই এবং সেই পুরনো দিনের মতোই সকালে পান্তা ইলিশ এবং সবাই মিলে দিনব্যাপী আয়োজন ঘুরে ফিরে অনেক আনন্দ উল্লাসের মধ্যদিয়ে সময় কাটাই। পহেলা বৈশাখের দিন নতুন পোশাক পরে সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ে কখনো চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন মোলহেড নদীর পাড় এলাকা নৌকা ভ্রমন করে, কখনো বা ডাব্লিউ রহমান জুটমেলের ভিতরে প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেদের তুলে ধরে, বৈশাখের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়।

এছাড়াও কোন, কোন বৈশাখে এসব করার পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসকদের ঘরোয়া পরিবেশে পান্তা ইলিশের আয়োজন, গানের আড্ডা সহ নানা গল্প-গুজর করে অনেক আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখের দিন পার করি। তবে বৈশাখে যতই আনন্দ-উল্লাস করি না কেনো সেই ছেলেবেলার মত বৈশাখের আনন্দ কখনোই মনের আঙ্গিনা ছুঁয়ে যায়নি। সেকালের বৈশাখ আর একালের বৈশাখের মাঝে অনেক অনেক তফাৎ রয়েছে। সেই ছেলেবেলা পার করে এখন এই মধ্য বয়সে এসে জীবনের পাতা জুড়ে বারবার বৈশাখ ফিরে এলেও, ফিরে আসেনি সেই শৈশবে বৈশাখের আনন্দ-উচ্ছ্বাস। তবুও প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে নিজেকে নতুন ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি। নতুন পাঞ্জাবি কিংবা যেকোন নতুন পোষাক পরে পান্তা ইলিশ ও বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ফিরে বৈশাখের আনন্দ-উল্লাসকে হৃদয়ে লালন করে সেই শৈশবের আনন্দ ফিরে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করি।

Share