দেশে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটার মতো ভোগ্যপণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে মিল নেই। সরকারি একেক সংস্থার তথ্য একেক রকম। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কখনো লাভবান হচ্ছেন, আবার কখনো লোকসান গুনছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ডালজাতীয় শস্য উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৩৮৩ টন। তেলজাতীয় শস্য ১২ লাখ ৩১৮ টন। গম উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬৭৩ টন।
উল্লিখিত তিনটি শস্য উৎপাদনের পরিমাণ সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য হলো—ডালজাতীয় শস্য ৪ লাখ ২৫ টন, তেলজাতীয় শস্য ৯ লাখ ৯৬ হাজার টন এবং গম ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন।
সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের অসামঞ্জস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘ন্যাশনাল এজেন্সি হিসেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ডেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। যেকোনো পরিকল্পনা ও গবেষণায় বিবিএসের ডেটাই গ্রহণ করা হয়। অন্য এজেন্সির ডেটার সঙ্গে অমিল হতেই পারে। তবে আমি মনে করি, বিবিএসের ডেটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘দেশের ১৪ হাজার ব্লকে একজন করে কর্মকর্তা আছেন। তাঁরা সরেজমিনে ঘুরে হাতে মেপে তথ্য দেন। কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোর মেথড পুরোনো। তবে চলমান তথ্যে গরমিল থাকলেও চূড়ান্ত করার সময় এক হয়ে যায়। এতে দ্বন্দ্ব বা আতঙ্কের কিছু নেই।’
অতিরিক্ত আমদানি-আবাদে লোকসান
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী জানান, ২০১৭ সালে হাওরাঞ্চলে বোরো ফসলের ক্ষতি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের চাল আমদানি করতে সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। তখন তিনিও ১ লাখ ২০ হাজার টন চাল আমদানি করেছিলেন। আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তাঁর সব চাল বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এতে তাঁর ১৫০-১৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়।
২০১৯ সালে ভারত সরকার হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশে পেঁয়াজের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। খুচরা বাজারে দাম উঠেছিল কেজিপ্রতি ২৬০ টাকা পর্যন্ত। পরের বছর পেঁয়াজ আবাদ বাড়িয়ে লোকসানের মুখে পড়েন কৃষকেরা।
এভাবে কখনো মোটা অঙ্কের মুনাফা, কখনো লোকসান দিচ্ছে দেশের মানুষ। এর অন্যতম কারণ, দেশে এসব পণ্যের নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান না থাকা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক সময় পণ্য আমদানি করে ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের মুনাফা করেন, আবার কখনো লোকসান দেন। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকলে বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
তথ্যে আরও গরমিল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল ২৬ লাখ টন, উৎপাদন হয় ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন, উৎপাদন ৮২ হাজার টন। মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন, উৎপাদন হয় ২ লাখ ৬০ হাজার টন। ছোলার চাহিদা ২ লাখ ১০ হাজার টন, উৎপাদন ৫ হাজার টন। খেজুরের চাহিদা ৬০-৭২ হাজার টন। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের প্রতিবেদনমতে, পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন, উৎপাদন ৩৫ লাখ ৪ হাজার টন। চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন, উৎপাদন ৩০-৪০ হাজার টন। মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন, উৎপাদন ২ লাখ ৬০ হাজার টন। ছোলার চাহিদা প্রায় ১ লাখ টন, উৎপাদন ৬ হাজার টন। খেজুরের চাহিদা ৪০ হাজার টন।
বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে অসামঞ্জস্য থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষও। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তথ্যের গরমিলে সমস্যা হয়। কে কোন পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করছে, সেটি দেখতে হবে। বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায়ও ডেটা সম্পর্কে কথা হয়। তবে এই মুহূর্তে সব ডেটা না দেখে মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’
সরকারি সংস্থার তথ্যে আস্থা নেই
সরকারি সংস্থার অনেক তথ্যের সঙ্গে একমত নন আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। লোকসান এড়াতে দেশের বড় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজস্ব তথ্যভান্ডার তৈরি করেছেন।
টিকে গ্রুপের পরিচালক সফিকুল আথহার তসলিম বলেন, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সরকারের পরিসংখ্যান অনুসরণ না করে নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্যভান্ডার তৈরি করেছেন। দেশে চাহিদা, উৎপাদন, ফলন, আমদানি, দাম সবকিছু দেখেই তাঁরা ব্যবসা করছেন, যাতে লোকসান কম হয়। তিনি আরও বলেন, সঠিক হিসাব না থাকলে ব্যবসায় লোকসান গুনতেই হবে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনেকটাই সঠিক বলে তাঁর দাবি।
নির্ভুল পরিসংখ্যান সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরিসংখ্যানে গরমিল থাকলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা তৈরি হয়, বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে। খাদ্যশস্যের সঠিক পরিসংখ্যান ও সংস্থার সমন্বয়ের অভাবে প্রায়ই বাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করে। এসব বিষয়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান থাকলে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। কখনো খোলা বাজারে বিক্রি করা প্রয়োজন হবে কি না, সেটির সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।