Home / সারাদেশ / বেতনের টাকায় ১২টি শিক্ষা কেন্দ্র চালাচ্ছেন এরফান আলী
বেতনের টাকায় ১২টি শিক্ষা কেন্দ্র চালাচ্ছেন এরফান আলী

বেতনের টাকায় ১২টি শিক্ষা কেন্দ্র চালাচ্ছেন এরফান আলী

বয়স্ক নারী-পুরুষসহ স্বাক্ষরজ্ঞানহীন সব বয়সের ব্যক্তিদের বিনামূল্যে পাঠদান করানোর জন্য নিজের বেতনের টাকায় ১২টি শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী।

উপজেলাকে উপজেলার ৩নং বকুয়া ইউনিয়নের বিকাল ও সন্ধ্যাকালীন দু-শিফটে ১২টি শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন তিনি।

পর্যায়ক্রমে হরিপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫৪টি ওয়ার্ডেই বয়স্ক নারী ও পুরুষসহ স্বাক্ষরজ্ঞানহীন সকল ব্যক্তিদের স্বাক্ষরজ্ঞান দেওয়ার জন্য একাধিক শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন এরফান আলী।

ওই শিক্ষককের এ রকম মহৎ উদ্যোগের ফলে এ অঞ্চলের অনেক বেকার যুবক পেলো তাদের কর্মসংস্থান এবং অন্যদিকে নিরক্ষতা মুক্ত হবে এ অঞ্চল।

সোমবার বিকালে উপজেলার সিংহাড়ী গ্রামের নারী শিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বিকাল সাড়ে ৪টা বাজতে আর ৫মিনিট বাকি আছে, পৃথক পৃথক ভাবে ৪০ জন বিভিন্ন বয়সের নারী বই-খাতা ও কলম নিয়ে শিক্ষা কেন্দ্র হাজির হয়। সাড়ে ৪টার বাজতেই শিক্ষক কেন্দ্রে এসে হাজির। শিক্ষক আসার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা নিতে আসা সকল নারী ঘরের মেঝেতে পানি মুথার পাটি ও পাটের চট বিছিয়ে সারি বদ্ধ হয়ে বসে পড়ে। ব্লাক বোর্ডের মাধ্যমে শুরু হয় বর্ণ পরিচয় শিক্ষা। শিক্ষককের ব্লাকবোর্ডের সাথে সাথে তাঁরাও তাদের খাতায় লিখছে বর্ণগুলি।

শিক্ষা কেন্দ্রে পড়তে আসা চল্লিশ বছর বয়সী এলেসা বিবি চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘আগে আমি নিজের নাম সই করতে পারতাম না। এই শিক্ষা কেন্দ্র পড়তে এসে এখন নিজের নামসহ অন্যের নামও লিখতে পারি। এতে আমি এখন খুব আনন্দ উপভোগ করছি।’

এ নিয়ে এতো আনন্দ কেনো জানতে চাইলে এলেসা বিবি জানান, ‘ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তি ও উপবৃত্তির টাকা উত্তোলনের সময় অভিভাবক হিসেবে মাকে বিভিন্ন জায়গায় স্বাক্ষর করতে হয়। তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার সময় স্বাক্ষরের বদলে টিপসই দিয়েছিলেন। উপস্থিত শিক্ষিত অনেক অভিভাববকরা উপহাস করেছিলো। সেদিন তিনি খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। আর যেন আমাকে কোথাও স্বাক্ষরের বদলে টিপসই দিয়ে আর লজ্জা পেতে না হয় সেই জন্য তিনি নিজেকে একজন স্বাক্ষরজ্ঞান হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিক্ষা কেন্দ্র আসেন।’

একই কেন্দ্রে পড়তে আসা লুৎফা বেগম বলেন, আমরা গরীব মানুষ। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। ঋণ নেওয়ার সময় ঋণ বইয়ে স্বাক্ষর করতে হয়। কিন্তু স্বাক্ষর বদলে টিপসই দেওয়ার সময় এনজিও কর্মীর নিকট অনেক বিব্রতবোধ প্রশ্নের সম্মূখিণ হতে হয়। তাই নিজেকে এই শিক্ষা কেন্দ্র এসে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্মন্ন করেছেন।

শতশত গরীব নারীরা এই শিক্ষা কেন্দ্রে বিনামূল্যে স্বাক্ষরজ্ঞান গ্রহণ করছে। টাকা খরচ করে এই বয়সে স্বাক্ষরজ্ঞান নেওয়া সম্ভব হতো না। বিনামূল্যে এই শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠদানের সুযোগ পেয়ে আমার মতো অনেক নারী নিজেকে স্বাক্ষরজ্ঞান মা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাচ্ছে।

স্বাক্ষরজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, দুই মাস ধরে তিনি এ শিক্ষা কেন্দ্রে বিকালে মহিলা ও সন্ধ্যায় পুরুষদের হাতে-কলমে ও ব্লাক বোর্ডের মাধ্যমে বর্ণ পরিচিত করে নিজের নাম লেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেকে নিজের নাম লিখতে শিখে ফেলেছে। তাদের দেখে এই অঞ্চলের অনেক নিরক্ষর মানুষ উৎসাহিত হয়ে কেন্দ্রে পড়তে আসছে।

চরভিটা গ্রামের শিক্ষা কেন্দ্রে পড়তে আসা তানু মোহাম্মদ, আমির ও সুলতান মিয়া বলেন, অভাব অনটনের কারণে শৈশব বয়সে লেখা-পড়া করার সুযোগ না পাওয়ার ফলে আমরা নিজের নাম স্বাক্ষর করতেন পারেন না। বিভিন্ন সময়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে ভর্তি ও ব্যাংক, বীমা, অফিস-আদালত এবং এনজিওসহ ইত্যাদি অফিসিয়াল কাজকর্মে স্বাক্ষরের পরিবর্তে আঙুলের টিপ দিয়ে হয়। টিপ দেওয়ার সময় এই বয়সে নানা রকম অসহনীয় বিব্রতবোধ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। শেষ বয়সে হলেও বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে তারা খুশি।

এ বিষয়ে চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এ কার্যক্রমের উদ্যোক্তা এরফান আলী বলেন, ‘হরিপুর উপজেলাকে নিরক্ষতা মুক্ত অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলতে আমি এ উদ্যোগ দিয়েছি। অশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানহীন নারী-পুরুষ বিভিন্ন সময়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে ভর্তি, উপবৃত্তির টাকা উত্তোলন ও ব্যাংক, বীমা, অফিস-আদালত এবং এনজিওসহ ইত্যাদি অফিসিয়াল কাজকর্মে স্বাক্ষরের পরিবর্তে আঙুলের টিপ দেওয়ার সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিকট নানা রকম অসহনীয় বিব্রতবোধ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের অনেক অপমান সইতে হয়। তাদের কথা চিন্তা করে আমি বিনামূল্যে শিক্ষাদান দেওয়ার সিন্ধান্ত গ্রহণ করি। যাতে এ অঞ্চলের আর কোন বাবা-মা ও ভাই-বোনেক বিব্রতবোধ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে অপমান যেন না হতে হয়। তাই আমি আমার স্কুলের পুরো বেতন দিয়ে এই শিক্ষা কার্যক্রম চালু করি। এর ফলে এ অঞ্চলের কিছু শিক্ষিত বেকার যুবকের সামান্য হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে এবং হরিপুর উপজেলা নিরক্ষতা মুক্ত সমাজ গঠন হবে।

তিনি আরো বলেন দুই বছরের মধ্যে আমি হরিপুর উপজেলার মধ্যে ৬টি ইউনিয়নের ৫৪টি ওয়ার্ডের নিরক্ষতা দূরীকরণ করে অশিক্ষিত মানুষকে স্বাক্ষর জ্ঞান শেখানোর চেষ্টা করবো। এরই মধ্যে ৩নং বকুয়া ইউনিয়নের সিংহাড়ী, বরমপুর, রুহিয়া, চরভিটা, তাঁতিহাট, চৈতা, ধুকুরিয়া, পীরহাট, ভূইসা, কান্দরপাড়, গোয়ালদীঘি ও ধীরগঞ্জ গ্রামে ১২টি দু-সিফটে এ শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছি। প্রতিটি শিক্ষা কেন্দ্রে এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের মাসিক বেতন দিয়ে শিক্ষক হিসাবে দিয়ে রাখা হয়েছে।

প্রতিবেদক- কবিরুল ইসলাম কবির, ঠাকুরগাঁও
:আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৬: ১৭ পিএম, ২৩ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ

Leave a Reply