রাজনীতি

বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় ‘পলিটিকস’!

রাজনীতির বাইরে তো কিছুই থাকে না। তার ওপরে বাংলাদেশের রাজনীতির রয়েছে রাজনৈতিক অসুস্থতার দীর্ঘ ইতিহাস। দৃশ্যত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে একটা তর্কাতর্কি সংযম সাধনার মাসে শুরু হয়ে সেটা এখন সামনে ঈদুল আজহা পর্যন্ত গড়াতে পারে।

আমরা কি এর একটা বিচারবিভাগীয় সুরাহা আশা করতে পারি? কারণ, দেখা যাচ্ছে, তাঁর চিকিৎসা কতটা গুরুতর, অর্থাৎ সেটা এত দিন যেভাবে চলছিল, তা যে আর সম্ভব নয়, সেটা থেকে সরকার কেন সরে এল, তা পরিষ্কার নয়।

প্রশ্নটা সর্বশেষ দাঁড়াচ্ছে, সরকার প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে যে কারা হাসপাতালে কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাঁর চিকিৎসা সম্ভব সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। আর বিএনপির অবস্থান হলো, তারা মনে করে, তাদের দলীয় চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসা ইউনাইটেড হাসপাতালেই হতে হবে।

বিষয়টি একান্তভাবেই চিকিৎসাসংক্রান্ত। কিন্তু বিষয়টি উভয় পক্ষ তাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে দাবি মানা না-মানার আটপৌরে বিষয়বস্তুতে পরিণত করে ফেলেছে। কারণ, খোঁজ নিয়ে জানলাম, শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারি পক্ষও ‘যথাযথভাবে গঠিত মেডিকেল বোর্ডে’র ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।

কেন বিএসএমএমইউয়ে বা সিএমএইচে নয়, শুধু ইউনাইটেড হাসপাতালেই যেতে হবে, সেটা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোনো মেডিকেল বোর্ডের বরাতে উল্লেখ করেননি। আবার এর আগে সরকারকে আমরা খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারজন অধ্যাপককে দিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে দেখেছি। এমনকি সেই বোর্ডের মতামত আমরা আইজি প্রিজনের মতো মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা কাউকে প্রকাশ করতে দেখিনি। তখন ওই বোর্ডেরই একজন অধ্যাপককে মুখপাত্র হিসেবে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু রোজার পঞ্চম দিনে বিএনপির দাবি মতো ‘অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার’ ঘটনার পর থেকে আমরা একটা উদ্বেগজনক অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।

উভয় পক্ষ ক্রমাগত নির্দিষ্টভাবে কোনো চিকিৎসকের বরাত ছাড়াই স্বাস্থ্যগত বিষয়ে অবিরাম পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাখছে। এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারকে শুধু তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেই হবে না, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির স্বার্থে জনগণকে এটা জানাতে হবে যে কারা, কখন, কীভাবে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন, তাঁরা লিখিত, নাকি মৌখিক প্রতিবেদন দিয়েছেন। সেটা জানলে নাগরিকেরা, তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তা সরবরাহের জন্য দরখাস্ত করার অধিকার অনুশীলন করতে পারবে।

অন্যদিকে, আমরা জানি, বিএনপি-সমর্থক স্বনামধন্য চিকিৎসকের কমতি নেই। তাহলে তাঁরা কেন এ পর্যন্ত কোনো লিখিত বিবৃতি দেননি। আমরা কি অনুমান করেই সন্তুষ্ট থাকব যে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম তাঁর নেত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ে যা বলেছেন, তা আসলে তাঁর নিজের মত নয়, বিশেষজ্ঞদের মত দ্বারা সমর্থিত। জনগণকে অন্ধকারে রাখা বা একটি কম স্পষ্ট করা বিষয় হিসেবে ঝুলিয়ে রাখার অধিকার বিএনপিরও নেই।

গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে দলের বিএনপিপন্থী চিকিৎসকনেতা ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে দেখলাম। কিন্তু কথা বললেন মির্জা ফখরুল। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যগত বিষয়ে কথা বলতে সরকার ও আওয়ামী লীগের অবস্থানে পরিষ্কার পার্থক্য থাকা দরকার। সরকারের চিকিৎসকেরা তাঁর স্বাস্থ্যের বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য দেবেন। তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো পরিবর্তন ঘটলে তা নিয়মিত বুলেটিনের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষকে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। আর বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত বিষয়কে ‘ইস্যু’ বানানোর যে কথিত চেষ্টা, সে বিষয়ে বক্তব্য দেবেন আওয়ামী লীগের কোনো মুখপাত্র। কিন্তু আমরা দেখছি, বেগম খালেদা জিয়ার ‘স্বাস্থ্য কিংবা স্বাস্থ্য-রাজনীতির’ বিষয়ে সরকারি বোর্ডের পেশাদার মুখপাত্রের কোনো বক্তব্য নেই। বিএনপির বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিকীকরণ’ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অনেকেই অবিরাম বক্তব্য দিচ্ছেন।

মির্জা ফখরুল গতকাল বলেছেন, ‘আমরা হাসপাতালের কথা কেন বলছি, তাঁর যে রোগগুলো, তা শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় নয়, তাঁর সুচিকিৎসার প্রয়োজন আছে। খালেদা জিয়া যেসব অসুস্থতায় আক্রান্ত, এর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দরকার। পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, তিনি প্রকৃত সত্য বা যে কথাটি বলা দরকার, তা তিনি যে কারণেই হোক প্রকাশ করতে অপারগ কিংবা তিনি প্রকারান্তরে বলছেন, বাংলাদেশে এই নির্দিষ্ট হাসপাতালটিতেই খালেদা জিয়ার ‘সুচিকিৎসা’ সম্ভব, অন্যত্র নয়।

প্রথম আলোর পাঠকেরা স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি যে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে উদ্‌গ্রীব জেনারেল এরশাদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপরই ‘চিকিৎসার’ জন্য নাটকীয়ভাবে র‍্যাব এসকর্ট করে তাঁকে সিএমএইচে তুলে নিয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩ বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদন ছিল, এরশাদ অন্তরীণ, নাকি অসুস্থ—এই জল্পনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী জেনারেল এরশাদের সঙ্গে সিএমএইচে সাক্ষাৎ করেন। ‘এ সময় রিজভীর স্ত্রীকে হাস্যরত এরশাদকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে দেখা যায়। স্লিপিং গাউন পরিহিত এরশাদকে এ সময় সম্পূর্ণ রিল্যাক্সড থাকতে দেখা যায়।’

আগামী নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য অংশ নেওয়া বা বয়কট করার জল্পনার মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল কারান্তরালে থাকবেন না, নির্বাচনেও অংশ নেবেন। মেডিকেল বোর্ড গঠন এবং স্বাস্থ্যগত কারণে জামিন লাভের চেষ্টা সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, তাঁরা আস্থা পান না। মেডিকেল বোর্ডে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাই থাকেন। আবার আদালতেও তাঁদের ভরসা কম। কিন্তু তিনি নিশ্চয় মানবেন যে তাঁর মুখে ‘মাইল্ড স্ট্রোকে’র তথ্য জানতেও মানুষের আস্থাশীল হওয়ার কথা নয়। আবার আইজি প্রিজন যখন বলেন, তিনি ‘অজ্ঞান’ হননি, ‘ইমব্যালান্সড’ হয়ে পড়েছিলেন, তখন আমজনতা কিন্তু সংশয়মুক্ত হতে পারেন না। আইজিপি প্রিজন ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যয়বহুল খরচাপাতির কথা তুললে বিএনপি যেই বলল, তারাই খরচ দেবে, তখন সবকিছুই গোল পেকে গেল। এমতাবস্থায় কীভাবে ‘যথাযথ মেডিকেল বোর্ড’ হয়, তা আদালত সাব্যস্ত করতে পারেন।

অসুস্থতার কারণে জামিন ও সুচিকিৎসা বিষয়ে আমাদের উচ্চ আদালতের গাইডলাইন কিছুটা আছে। কিন্তু তা খুব স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হয় না। এক-এগারোতে আমরা স্বাস্থ্যগত কারণে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করতে শুনেছি। দুদক তখন দণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে তৎকালী পিজির (বর্তমানের বিএসএমএমইউ) মেডিকেল বোর্ডের অনুকূল প্রতিবেদন নাকচ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যগত কারণকে মানবিক জায়গা থেকে দেখতে পারেনি। যেমন ইকবাল মাহমুদের (টুকু) মামলায় তখন দুদক বলেছিল, আপিল বিচারাধীন থাকতে জামিন চলবে না, কারণ তিনি ইমার্জেন্সি আইনে দণ্ডিত হয়েছেন। একই আইনজীবী এখন জামিনের বিরোধিতা করতে ইমার্জেন্সি আইন না থাকায় ভিন্ন যুক্তিকে বড় করে দেখাতে চাইছেন।

৬০ ডিএলআরে আপিল বিভাগের একটি রায় ছাপা আছে। তাতে বলা আছে, যখন দণ্ড তিন বছর থাকবে এবং অসুস্থতার কারণে জামিনের দরখাস্ত করার আগামী ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার (আপিলকারীর কোনো দায় থাকবে না) সম্ভব হবে না কিংবা যথাযথভাবে গঠিত মেডিকেল বোর্ড জীবনের প্রতি গুরুতর হুমকি বিবেচনায় সনদ দিলে জামিন মঞ্জুর হতে পারে।

আপিল বিভাগ এর আগে বেগম জিয়াকে জামিন দিয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের বিচার সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। রাষ্ট্র বলেছে, এই সময়সীমা মানা সম্ভব। তাহলে প্রশ্নটা থাকছে, ‘যথাযথভাবে গঠিত মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার জীবনের প্রতি গুরুতর হুমকি বিবেচনায় কোনো সনদ দিলে তার ভিত্তিতে জামিন মঞ্জুর হওয়ার’ শর্তের ওপর।

কীভাবে যথাযথভাবে বোর্ড গঠিত হবে, তা আইনে নির্দিষ্টভাবে বলা নেই। ২০০৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর টুকুর মামলায় তৎকালীন পিজির ছয় অধ্যাপকের দ্বারা গঠিত বোর্ডের সুপারিশ মেনেছিলেন হাইকোর্ট। বলেছিলেন, এটি যথাযথভাবে গঠিত। এখন কীভাবে হতে পারে, তা আদালত নির্দিষ্ট করতে পারেন।

তবে মুশকিল হলো, ভারতীয় রাজনীতিক লালু প্রসাদ যাদবকে আমরা নাকচ করতে পারি না। লালুর সরস একটি বচন হলো: ‘রাজনীতিমে বহুত পলিটিকস হ্যায়।’ আমরাও বলতে পারি, ‘বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসামে বহুত পলিটিকস হ্যায়।’

Share