সারাদেশ

বুড়িগঙ্গায় দুর্ঘটনার দায় ময়ূর-২ এর লঞ্চ চালকদের

বুড়িগঙ্গায় ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চডুবির ঘটনায় চাঁদপুৃরের এমভি ময়ূর ২-এর চালকদের প্রধানত দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি। বেঁচে যাওয়া যাত্রী, বিআইডব্লিউটিএ, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রায় সব বিষয়ে মতৈক্য পৌঁছেছেন দুই কমিটির সদস্যরা।

কমিটি আরও তথ্য পেয়েছে, ময়ূর লঞ্চটি নির্দিষ্ট সময়ের কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা আগে লালকুঠি (সদরঘাট) ঘাটে আসছিল। আসার পথে ময়ূর-২ লঞ্চটি প্রথমে মর্নিং বার্ডকে পেছন দিকে পরে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। এতেই সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায় লঞ্চটি। এছাড়া মর্নিং বার্ডের চালকের আসনে যার থাকার কথা ছিল তিনি ছিলেন না। তার পরিবর্তে সেখানে ছিলেন অন্যজন। তিনিও লঞ্চডুবিতে মারা যান।

লঞ্চের মাস্টার ও ড্রাইভারের অদক্ষতা এবং অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ময়ূর ২-এর মালিকের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সি হর্স কর্পোরেশনের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন ফোনে তদন্ত কমিটির সদস্যদের জানিয়েছেন।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আলাদাভাবে কমিটি দুটি গঠন করে। দুই কমিটি সোমবার আলাদা প্রতিবেদন জমা দিতে পারে। উভয় প্রতিবেদনেই এসব বিষয় উল্লেখ থাকবে।

এছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সদরঘাটের এপাড়-ওপাড়ে লঞ্চ বেঁধে রেখে চলাচলের পথ সরু করে ফেলা, একই নদীতে ছোট ও বড় লঞ্চ চলাচলের বিষয়ে করণীয় নিয়ে সুপারিশ করতে যাচ্ছে দুই কমিটি। দুই কমিটির ৬ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দুই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ঘটনার সময়ে দুটি লঞ্চেরই ফিটনেস সনদ ছিল। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ জনের বক্তব্য নিয়েছেন। এর মধ্যে মর্নিং বার্ড লঞ্চের বেঁচে যাওয়া ১১ যাত্রীও রয়েছেন। তারা ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পরিবহন অধিদফতর, নৌ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা লঞ্চডুবির কারণ প্রসঙ্গে বলেছেন, ময়ূর-২ লঞ্চটি হঠাৎ করেই মর্নিং বার্ড লঞ্চের দিকে চেপে আসছিল। প্রথমে পেছন দিকে ধাক্কা দিলেই লঞ্চের ভেতরে হইচই শুরু হয়। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আরেক ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। তারা এ ঘটনায় ময়ূর-২ লঞ্চের মাস্টার, ড্রাইভার ও সুকানিকে দায়ী করেছেন।

অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএর কমিটি ৪-৫ জন বেঁচে যাওয়া যাত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারাও এ দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর-২ লঞ্চের চালকদের অদক্ষতা ও বেপরোয়া মনোভাবকে দায়ী করেছেন।

এদিকে বারবার চিঠি ও ফোন দেয়ার পরও ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক ও চালক কেউই দুই তদন্ত কমিটির কাছে কোনো তথ্য ও সাক্ষাৎকার দেননি। ঘটনার পর তারা পলাতক রয়েছেন। তবে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিকের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সি হর্স কর্পোরেশনের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন ফোনে তদন্ত কমিটির সদস্যদের জানিয়েছেন, লঞ্চের মাস্টার ও ড্রাইভারের অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ময়ূর-২ লঞ্চের কেরানি সেলিম কমিটিকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময়ে তিনি লঞ্চে ছিলেন না। এ কারণে দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটেছে, কে লঞ্চ চালিয়েছে তা তিনি জানেন না।

বিআইডব্লিউটিএ গঠিত কমিটির একাধিক সদস্য নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, তাদের কমিটি ময়ূর-২ লঞ্চটির দু’জন চালকের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন। তারা হলেন- বাশার ও জাকির। ঘটনার সময়ে সদরঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. সেলিম মিয়া ও বার্দিং সারেং তৌহিদুল ইসলাম কমিটিকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

তারা বলেছেন, দুর্ঘটনার পর লঞ্চটি যখন ঘাটে এসেছিল তখন ওই দুই চালককে সামনের অংশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

দুই কমিটি সূত্রে আরও জানা গেছে, ময়ূর-২ লঞ্চটি ঢাকা-চাঁদপুর রুটে চলাচল করত। বেলা সাড়ে ১২টায় লালকুঠি ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী ২ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ সাড়ে ১০টায় ওই ঘাটে যাত্রী তোলার জন্য আসার কথা ছিল। কিন্তু ময়ূর-২ লঞ্চটি ৯টার পরপরই ঘাটে আসার সময়ে মর্নিং বার্ডকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনায় লঞ্চ ঘাটের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হচ্ছে কমিটির প্রতিবেদনে।

নৌ মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির একাধিক সদস্য জানান, মর্নিং বার্ড মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম ঘাট ছেড়ে আসার সময়ে সেখানের বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক সুপারভাইজার তাজরুল ইসলাম সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ওই ঘটনায় ইতোমধ্যে তাকে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয়েছে। এ ঘটনায় তাকেও দায়ী করা হচ্ছে। এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা ছিল কিনা তাও দেখা হচ্ছে। এছাড়া মর্নিং বার্ডটি একটি তৃতীয় শ্রেণির মাস্টার চালানোর কথা থাকলেও সেটি একজন সুকানি চালিয়েছেন। দুর্ঘটনায় ওই সুকানি মারা গেছেন।

তবে প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি কমিটির প্রধানরা। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৭ দিন সময় দেয়া হয়েছে। বেধে দেয়া সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়ার চেষ্টা করব। প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত চলা অবস্থায় মন্তব্য করা ঠিক হবে না। অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএ গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মো. জয়নুল আবেদিন বলেন, সোমবার কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার আশা করছি। এর বাইরে আর কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

সোমবার ঢাকা নদী বন্দরের (সদরঘাট) কাছাকাছি মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবে যায়। ওই ঘটনায় মারা গেছেন ৩৪ জন। ঘটনা তদন্তে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ পরিবহন অধিদফতর পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করে। তদন্তের মাঝপথে নৌ পরিবহন অধিদফতর গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির দুই সদস্যকে বৃহস্পতিবার রদবদল করা হয়েছে। এ কমিটির নতুন আহ্বায়ক করা হয়েছে ভৈরবের সার্ভেয়ার এহতেসানুল হক ফকিরকে ও সেখানকার ইন্সপেক্টর শাজাহান সিরাজকে সদস্য করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম বহাল আছেন। এ কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সাক্ষ্য দিয়েছেন সুমন বেপারি : জানা গেছে, কমিটির সদস্যরা ১ জুলাই সুমন বেপারির সাক্ষাৎকার নিতে হাসপাতালে গেলে তাকে পাননি। এর আগেই হাসপাতাল ছেড়ে এলাকায় চলে যান তিনি। তবে ফোনে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, মুন্সীগঞ্জ থেকে আসার সময়ে হঠাৎ করে ময়ূর-২ লঞ্চটি ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড ডুবে যায়। তখন তিনি চেষ্টা করেও বের হতে পারেননি। ভেতরে রড ধরে আল্লাহ আল্লাহ করছিলেন। এরপর তার আর কিছু মনে নেই। তবে হঠাৎ করে লঞ্চ নড়াচড়া শুরু করার বিষয়টি টের পেলে তিনি বেরিয়ে আসেন।

ময়ূর-২ লঞ্চের তালা ভেঙে আজ ঢুকবে কমিটি : দুর্ঘটনার পরই ফরাশগঞ্জ ঘাটে ময়ূর-২ লঞ্চের সব গেট তালা দিয়ে পালিয়ে যায় স্টাফরা। এ কারণে লঞ্চ পরিদর্শনে যেতে পারেননি কমিটির সদস্যরা। আজ একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কমিটির সদস্যরা লঞ্চটি পরিদর্শনে যাবেন। লঞ্চের তালা ভেঙে তারা ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বার্তা কক্ষ,৪ জুলাই ২০২০

Share