চাঁদপুরে মেয়াদোত্তর টাকা পরিশোধে বীমা কোম্পানির টালবাহানা, গ্রাহকদের হয়রানি

বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ৭৯টি বীমা কোম্পানি বীমা সেবা দিচ্ছে যার মধ্যে ৩৩টি লাইফ বীমাকারী কোম্পানি এবং ৪৬টি নন-লাইফ বীমাকারী কোম্পানি। লাইফ বীমাকারী কোম্পানির মধ্যে ১টি সরকারী এবং ৩২টি বেসরকারি মালিকানাধীন। অন্যদিকে নন-লাইফ বীমাকারী কোম্পানির মধ্যে ১টি সরকারী এবং ৪৫টি বেসরকারি মালিকানাধীন।

বর্তমানে দেশের বীমা কোম্পানীগুলো এক অনির্ধারিত অস্থিরতার মধ্যে দিন পার করছে। প্রথম সারির বীমা কোম্পানীগুলো গ্রাহকদের মেয়াদোত্তর বীমা দাবি নিস্পত্তি করতে রীতিমতো পালিয়ে বাঁচার মতো অবস্থায় রয়েছে। এতে স্থানীয় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রাহি অবস্থা। কোম্পানীর দায় এখন তাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। অফিসেও ঠিক মতো বসতে পারছেন গ্রাহদের চাপের কারণে। সময় মতো টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানীগুলোর স্থানীয় অফিসগুলো এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গ্রাহকের মেয়াদোত্তর টাকা পরিশোধের জন্য কোম্পানীগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।

এসব কোম্পানীগুলোর মধ্যে নতুন বাজার এলাকায় জেএমসেনগুপ্ত রোডে অবস্থিত পদ্ম লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর মানুষের মেয়াদোত্তর টাকা নিয়ে ব্যাপক টালবাহানার কারণে তাদের অফিস এখন প্রায় অচল। গ্রাহকদের হয়রানী চরম আকার ধারণ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শত শত মানুষের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

চাঁদপুর সদরের হামনকর্দী এলাকার লাকি বেগম অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘ ১ বছর যাবৎ তাদের অফিসে যাতায়াত করেও আমার টাকা পাচ্ছি না। দেই দিচ্ছি বলে বছরের পর বছর ঘুরাচ্ছে বলে অনেই অভিযোগ করেছেন। এমনি একজন জাঙ্গার হোসেন খান জানান তিনিও দীর্ঘদিন যাবৎ ডিপিএস এর মেয়াদ শেষ হয়েছে কিন্তু মুল টাকা ফেরত দিচ্ছে না। বছরের পর বছর ঘুরাচ্ছে দেবো দেবো বলে। এভাবে শত শত মানুষের টাকা এখন কোম্পানীর পকেটে। গ্রাহকের টাকা পাচ্ছে না কিছুতেই।

অপর দিকে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গ্রাহকের মেয়াদোত্তর টাকা পরিশোধে করতে পারছে না কোম্পানিটি। চাঁদপুর হাকিমপ্লাজাস্থ ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ চাঁদপুর সার্ভিস সেন্টারের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে এসব বিষয়ে আলাপ করলে তারা বলেন, ‘কোম্পানীর এমন অবস্থার কারণে আমরা মাঠে যেতে পারছি না। যেখানে যাই গ্রাহকরা আমাদেরকে ধরেন। তাছাড়া ফারইষ্টে আনেক কর্মকর্তা ফারইষ্ট ছেড়ে অন্য কোম্পানীতে চলে গিয়েছে। বর্তমানে ফারইষ্টের গ্রাহকদের স্থানীয় অফিসে আদায়কৃত অন্য গ্রাহকদের আমানত দিয়ে কিছু টাকা পরিশোধের চেষ্টা করলেও চাপ সামলাতে পারছে না। আবার যেসব গ্রাহকদের আমানত ভেঙ্গে অন্য গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে ঐসব গ্রাহকদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে তাও কেউ বলতে পারছে না।’

খবর নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত কোম্পানীগুলোর মেয়াদোত্তর তহবিল একেবারেই শূণ্য অবস্থায় রয়েছে। পরিচালনা পরিষদের সীমাহীন দুর্ণীতির কারণে গ্রাহকের ভাগ্য এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

তথ্য মতে দেশের সরকারি জীবন বীমা সহ মোট ৩৪টি জীবন বীমা কোম্পানীর মধ্যে বেশ কয়েকেটি পুরনো কোম্পানী এখন মেয়াদোত্তর দাবী নিস্পত্তিতে নিদারুন ভোগান্তিতে ফেলেছে গ্রাহকদেরকে। বছরকে বছর ধর্না দিয়েও জমানো টাকা উত্তোলন করতে পারছে না অধিকাংশ গ্রাহক। প্রথম সারীর কোম্পানীগুলোর মধ্যেই এখন গ্রাহক হয়রানী সবচেয়ে বেশী।

এসব কোম্পানীগুলো মেয়াদের নির্ধাতি তারিখের টাকা পরিশোধে সময় নিচ্ছে ২ থেকে ৩ বছর। অনেকে বীমা অফিসে ধর্না দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে টাকা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে অসংখ্য গ্রাহক। আইনগত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে সরকারের কোন প্রশাসনই গ্রাহকের টাকা পাইয়ে দিতে এগিয়ে আসছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদে। কিছু কিছু ইন্স্যুরেন্স অফিসে যারা প্রভাব খাটাতে পারেন কেবল তাদেরকেই টাকা ফেরৎ দিচ্ছে বাকি গ্রাহকদেরকে শুধু তারিখের পর তারিখ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।

এদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ বীমা কোম্পানীগুলো গ্রাহকে আরেকটি বীমা গ্রহণ করতে বাধ্য করেন তা না হলে টাকা পাওয়া যাবে না বলে জানান অথবা বলেন কবে পাবেন তার কোন ঠিক নেই। এসব কথা শুনে গ্রাহকরা নিরুপায় হয়ে নতুন একটি পলিসি গ্রহণ করে মেয়াদোত্তর টাকা পাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করছে। শুধু তাই নয় অনেক গ্রাহক জানেনই না যে তার আরেকটি বীমা গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রাহককে না জানিয়ে অনেক বীমা কোম্পানী বীমা থেকে টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা দিচ্ছে বলে অভিযোগ অনেক গ্রহাকের। তবে ঐসব কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তা বলছেন কোন গ্রাহককেই না জানিয়ে কিংবা জোর করে বীমা করানো হয় না। গ্রাহক স্বেচ্ছা বীমা করেন।

বলতে গেলে চাঁদপুরে বর্তমানে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ নিয়ে নিদারুন টালবাহানা করছে বীমা কোম্পানীগুলো। আদৌ টাকা ফেরত পাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছেন অনেকে নিদারুন দুশ্চিন্তায়।

এসব কোম্পানীগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী, পপুলার লাইফ, সালফ্লাওয়ার লাইফসহ বেশ কয়েকেটি বীমা কোম্পানী। গ্রাহদের টাকা পরিশোধের হয়রানি নিয়ে এসব অফিসের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কিছু কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, কোম্পানী উচ্চ মহলে দুর্নীতি হয়েছে তাই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে দেরি হচ্ছে। আবার অনেকে বলেন, আমাদের কিছু করার নাই প্রধান কার্যালয় যেভাবে দেয় আমরা সেভাবেই পরিশোধ করি। আমাদের কিছুই করার নেই।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বীমা শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম হলেও কোম্পানীগুলোর দুর্ণীতির কারণে বীমার উন্নয়নে সরকারের সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ইতোমধ্যে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগে ফারইষ্ট ও ডেল্টা লাইফসহ বেশ কয়েকেটি বীমা কোম্পানীর পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়েছে সরকার। বর্তমানে এসব কোম্পানীগুলোর গ্রাহক হয়রানী চরম আকার ধারণ করেছে। এসব কোম্পানীর গ্রাহকরা তাদের জমানো টাকা আদৌ ফেরত পাবে কি না তা নিয়ে রয়েছেন দুঃশ্চিন্তায়। বর্তমানে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের গ্রাহকদের মেয়াদোত্তর টাকার জন্য আবেদন করতে গেলেই গ্রাহককে বলা হচ্ছে টাকা পেতে ২-৩ বছর সময় লাগবে। অনেক গ্রাহক ইতিপূর্বে ১ থেকে ২ বছর অফিসে অফিসে ধর্না দিয়ে আসলেও তারা টাকা না পাওয়ার কথা জানান।

গত বেশ কিছু দিন ফারইষ্ট লাইফ, পদ্মা, হোমল্যান্ড, পপুলার, প্রাইম লাইফসহ বেশ কয়েকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানাযায় অনেক অফিসে গ্রাহকরা এসে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে। টাকা পাওয়ার জন্য গ্রাহকরা অফিসে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্না দিয়ে যখন টাকা না পান তখন কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও কোন সমাধান না পেয়ে হাল ছেড়ে দেন।

চাঁদপুরে ইন্স্যুরেন্স অফিসগুলোর চিত্র এখন এমনই ভয়াবহ যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরার থাকেন উৎকণ্ঠার মধ্যে।
এদিকে পুরনো কোম্পানীগুলোর এমন চিত্রের কারণে নতুন কোম্পানীগুলো মার খাচ্ছে বলে মনে করছেন নতুন কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তারা। মেয়াদোর টাকা পরিশোধে গড়িমসির কারণে মানুষ ইন্স্যুরেন্স থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে মনেকরছেন অনেকে। বীমা দাবী বা মেয়াদোত্তর বীমা দাবি পরিশোধের জন্য সরকারের কোন তদারকি নেই। যার কারণে কোম্পানীগুলো সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে তামাশায় লিপ্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন অনেক বীমাবিদ। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্র কর্তৃপক্ষ (ইদরা) এর জেলা পর্যায়ে কোন অফিস নেই এমনকি তাদেরকে তদারকি করার মতো জেলা পর্যায়ে কেউ নেই। ইদরা শুধু বীমা অফিসের প্রধান কার্যালয় নিয়ে কাজ করে বিধায় গ্রাহক হয়রানি থামছে না বলে মনেকরছেন অভিজ্ঞ মহল। এমন সুযোগে বছরের পর বছর ধরে বীমা কোম্পানীগুলোর গ্রাহক হয়রানী চলে আসলেও সেদিকে কারো কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। তাই এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।

স্টাফ করেসপন্ডেট, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

Share