সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে নিহতদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ ও পুরুষ। পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে এরা সব মরে গেছেন। অসংখ্য পুরুষ মৃত্যুভয়ে দেশটি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার হাত থেকে বাঁচতে, বিমান হামলায় মারা পড়ার ভয়ে বা বিদ্রোহী মিলিশিয়া ও জঙ্গিদের ভয়ে সিরিয়ার বেশিরভাগ পুরুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
আর সরকারি বন্দীশালাগুলোতে আটক আছেন হাজার হাজার পুরুষ।
এই অবস্থায় সিরিয়ার সমাজে পুরুষ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার ফলে দেশটির যেসব নারী বিয়ে-সংসার করতে ও সন্তান জন্মদানে আগ্রহী তারা পড়ে গেছেন মহাবিপাকে।
এমনই এক নারী শুকরান। ৩২ বছর বয়সী এই নারী এখনো অপ্রত্যাশিতভাবেই অবিবাহিত রয়ে গেছেন। তার বেশিরভাগ পুরুষ বন্ধুরাই হয় যুদ্ধে মারা গেছেন বা জেলে আটক রয়েছেন অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে দেশটির বিবাহযোগ্য নারীদের ৭০ শতাংশই স্বামী সংকটে ভুগছেন।
শুকরান বলেন, যথাযথ একজন স্বামী পাওয়াটা এখন প্রায় পুরোপুরি অসম্ভবই হয়ে পড়েছে। প্রেমিক জোটানো খুব একটা কঠিন না হলেও উত্তোরত্তর বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িকতা ও গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে নিজ ধর্ম বা নৃগোষ্ঠেীর বাইরে বিয়ে করাটা একটি জঘন্য ঘৃণ্য কর্ম হিসেবে গণ্য হয়। সম্প্রতি শুকরানের সঙ্গে তার প্রেমিকের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। কারণ শুকরানের প্রেমিক ছিলেন খ্রিস্টান; আর তিনি নিজে একজন দ্রুজ মুসলিম।
এছাড়া টাকার অভাবও একটি বড় কারণ। সিরিয়ার বড় বড় শহরগুলোতে চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরে এবং জুতার তলা ক্ষয় করেও দেশটির লাখ লাখ তরুণ একটি মর্যাদাপূর্ণ বেতনের চাকরি যোগাড় করতে পারছিলেন না। পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া বিদ্রোহের পেছনে এটিও একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
এখনকার পরিস্থিতিতো আরো খারাপ। সিরিয়ান পাউন্ডের দাম দশভাগ কমে গেছে। আর এখন মাসে গড় মুজুরি হলো মাত্র ৫০ ডলার। সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অনুযায়ী একজন পুরুষকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীকে দেওয়ার জন্য সোনার আংটি দরকার হয়। বর্তমানে মাত্র এক গ্রাম সোনার দাম ১৭ হাজার সিরিয়ান পাউন্ড (৩৪ ডলার)। একটি আংটি বানাতে গড়পড়তা ১৮ গ্রাম সোনা লাগে। যা এখন কোনো পুরুষের পক্ষে যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও পণের টাকা যোগাড়ের হ্যাপাতো রয়েছেই, যা সরাসরি মেয়ের পরিবারকে দিতে হয়। এর সর্বনিম্ন পরিমাণ কোনো যুবকের চাকরির চার থেকে ছয় মাসের বেতনের সমান।
পরিবারগুলো এই টাকা না দিলে এমনকি বিয়ে ভেঙ্গে দিতেও কসুর করে না। ফলে বিয়ে করাটা পুরুষদের জন্য সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। জারা নামের ২৩ বছর বয়সী এক নারী জানান, তার বন্ধুমহলে এখন প্রতি একজন পুরুষের বিপরীতে নারী রয়েছেন চারজন!
জারা বলেন, “১৯৮০-র দশকের শেষদিকে বা ১৯৯০-র দশকের শুরুতে যাদের জন্ম হয়েছে পুরুষদের সে প্রজন্মটি হারিয়ে গেছে। তারা হয়তো মাত্র পড়ালেখা শেষ করে কোনো কাজে যোগ দিতে চাইছিল আর ঠিক সেই সময়েই চলমান এই সংঘাতের শুরু হয়।”
জারা আরো বলেন, “আমাদের পুরুষরা সব মরে গেছেন। আর একজন নারীর জন্য এখন স্বামী, ভালো স্বামী খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ যদি কায়ক্লেশে একজন স্বামী যোগাড় করতে সক্ষমও হন তাহলেও দেখা যাবে যে তিনি হয়তো সারাক্ষণই সামরিক পোশাক পরে রয়েছেন। এমনকি কোনো পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়ার পরপরই মনের মাঝে যে চিন্তাটি উঁকি দেয় তা হলো- এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে? সে কি পালিয়ে যাবে, নাকি সরকারি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিবে?”
সে যদি সামরিক বহিনীতে যোগ দেয় তাহলে সবকিছুই খুব কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে গেলে টানা এক থেকে দুই বছেরেরও বেশি সময় পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মেলে না। আর সে যদি পরিবারের একমাত্র ছেলে হয় তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে কাজ করার হাত থেকে মুক্তি পেলেও চাকরি পাবে না; কারণ চাকরি এখন সোনার হরিনের চেয়েও আরো দুর্লভ কিছু।
৩৫ বছর বয়সী গুফরান জানান, বেশ কয়েকজন যুবক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এদের বেশিরভাগেরই নজর ছিল তার চাকরি ও বেতনের দিকে। তার অভিযোগ সিরিয়ার যুবকদের বেশিরভাগই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত। সন্তান লালন-পালনের জন্য তাদের হাতে কোনো অর্থকড়ি নেই। তারা সবসময় খালি কাজ ও সেনাবাহিনী নিয়ে অভিযোগ করে। ফলে তিনি এদের সাথে নিরাপদ বোধ করি না।
গুফরান জানান, সেনাবাহিনীতে কাজ করে এমন কাউকে তিনি বিয়ে করতে রাজি নন। কারণ একজন সৈনিক মাসে মাত্র তিন থেকে চারদিন ছুটি পায়। সিরিয়ার যুদ্ধের আরেকটি ফলাফল হলো- অল্পবয়সী নারীরা ৫০ বা তারও বেশি বয়সী পুরুষদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন।
বুড়োরা এখন তরুণীদেরকে প্রেম, যৌনতা অথবা দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন।
গুফরান জানান, দামেস্কের যত তরুণীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের প্রায় সবার ভাগ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
আর কঠোর দারিদ্র ও যুদ্ধপীড়িত রক্ষণশীল সুন্নি মুসলিমদের অবস্থাতো আরো খারাপ।
রক্ষণশীল সুন্নী মুসলিমদের এলাকাগুলোর বেশিরভাগই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। সেসব এলাকার অবিবাহিত নারীরা আরো অবর্ণনীয় দুর্দশায় রয়েছেন। বিধবারা এনজিও বা জাতিসংঘের দানের টাকায় বেঁচে আছেন।
সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের বহুবিবাহ আগে থেকেই ছিল। আর এখন যেন তা আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে পণের টাকা ছাড়াই অনেক বাবা তার মেয়েকে যেনতেন স্বামীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। শুধু একটাই অনুরোধ- মেয়েটাকে মেরে ফেলো না; খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখো।
আর মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে পুরুষের অভাবে সমকামিতার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। জারা জানান, তার নারী বন্ধুদের ১০ থেকে ২০ শতাংশই পুরুষের অভাবে সমকামি বনে গেছেন।
শুকরান বলেন, “সিরিয় সমাজের কার্পেটের নিচে যে অসন্তুষ্টি চাপা পড়ে ছিল যুদ্ধের ফলে তা এখন পুরোপুরি উদোম হয়ে গেছে। লোকের মাঝে কোনো কিছু নিয়েই সন্তুষ্টি নেই। আমিও আমার যৌন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নই।”
মা হওয়ার জন্যও শুকরানের মধ্যে ব্যাপক আকুতি লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু একজন নারীর একার পক্ষে সন্তান লালন-পালন সম্ভব নয়। এমনকি দামেস্কের মতো বিশ্বজনীন ও বহুজাতিক শহরেও নয়।
শুকরান বলেন, “স্বামী পাওয়ার চেয়ে বরং একটি সন্তান জন্মদানের ব্যাপারেই আমার আকুতিটা বেশি। কিন্তু সন্তান জন্ম দিতে হলে সবার আগে বিয়ে করতে হবে।” আর সেটাই এই মুহূর্তে সিরিয়ায় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৬:০০ পিএম, ২৪ জুন ২০১৬, শুক্রবার
ডিএইচ