দীর্ঘ একযুগ ধরে অব্যাহত বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে রাজনীতি করছে বিএনপি। নানামুখী চাপ ও প্রতিবন্ধকতায় সংকুচিত হয়ে গেছে দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, সব পর্যায়ের নেতারাই বিপর্যস্ত নির্যাতন-নিপীড়নে। চেয়ারপারসন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে, হাজার হাজার নেতাকর্মী দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন জেলে। মোকাবিলা করতে হচ্ছে দলে ভাঙনের বিভিন্ন অপতৎপরতা।
এ নিয়ে একটি বিস্তর প্রতিবেদন তৈরি করেছে মানবজমিনের সিনিয়র প্রতিবেদক কাফি কামাল। তিনি দলটির ভুলভ্রান্তি নিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছে প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছেন এরইমধ্যে এ নিয়ে না বিশ্লেষণ সোস্যাল মিডিয়া ও ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে প্রকাশ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নানামুখী চাপ ও প্রতিবন্ধকতায় সংকুচিত হওয়া দলটিকে ছেড়ে যায়নি নেতাকর্মীরা। ন্যূনতম আস্থার সংকট দেখা দেয়নি শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর। সরকারের নানা পদক্ষেপে বিক্ষুব্ধ মানুষের সমর্থনও নিজেদের অনুকূলে এবং কখনো কখনো তাদের জনপ্রিয়তা ৮০-৯০ ভাগ বলেও বছরের পর বছর ধরে দাবি করে আসছেন দলটির নেতারা।
চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নেতাকর্মীরা যখন দলটির ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ, জনসমর্থনও যখন তুঙ্গে; তখন কেন ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি? কোথায় গলদ তাদের? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন এখন।
রাজনীতিতে ইউটার্ন নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল বিএনপি। গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়া দলটি ঐক্যফ্রন্ট গড়ে স্বপ্ন দেখেছিল একটি অনুকূল পরিস্থিতি ও সুদিনে ফেরার।
কিন্তু সে স্বপ্নটিই এখন তাদের সামনে দাঁড়িয়েছে সংকটের রূপ নিয়ে। দলটির কর্মীদের এখন দিশা হারানোর দশা। একাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে চলেছে যুক্তিতর্ক। দলটির নেতারাই বলছেন, এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল তাদের সামনে এক অনিবার্য বাস্তবতা।
প্রবল যুক্তিগ্রাহ্য কোনো বিকল্প ছিল না তাদের সামনে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, ‘এবার নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের পেছনে অনেক যুক্তি ছিল। তদুপরি এই নির্বাচনের মাধ্যমে দুটি জিনিস স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে এদেশে কোনোদিনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিকও বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেয়ে নির্বাচন পরিচালনায় দলটির নীতিনির্ধারক ফোরামের পদক্ষেপের প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। ২০১৫ সালের অদূরদর্শী টানা আন্দোলনের খেসারত হিসেবে পরের চারবছর অনেকটা নীরবে কেটেছে বিএনপির।
প্রশাসনের অনুমতি জটিলতায় তাদের কর্মকাণ্ড ছিল নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হবে- এমনটাই ভাবছিলেন দলটির নীতিনির্ধারক ফোরাম। তারই প্রেক্ষিতে নির্বাচনের দিন ফজরের নামাজের পর দলবেঁধে কেন্দ্রে যাওয়া, ভোটদানের পর ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্র পাহারা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি।
বাস্তবে ভোট রক্ষা ও ভোটকেন্দ্র পাহারায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি তারা। গড়তে পারেনি ন্যূনতম প্রতিরোধ। কিন্তু তার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার সেটা কি সত্যিই বিএনপির ছিল? তৃণমূল নেতাকর্মীদের কি নির্বাচন পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন দায়িত্বশীল নেতারা? নির্বাচন পরিচালনায় বিএনপির পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণ করে অনেকেই তার কয়েকটি দিক চিহ্নিত করেছেন।
তারা বলছেন, দলীয় মনোনয়ন প্রদানে রীতিমতো ছেলেমানুষী করেছে বিএনপি। অনির্ধারিত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যেন প্রার্থী শূন্যতা তৈরি না হয় তার জন্য বেশির ভাগ আসনেই একাধিক নেতার হাতে দেয়া হয়েছিল প্রাথমিক মনোনয়ন। নানাদিক যাচাই-বাছাই করে নয়, দলের মনোনয়নের চিঠিটি বিতরণ হয়েছিল রীতিমতো হরিলুটের স্টাইলে। এক একটি আসনে ৭-৮ জনকে পর্যন্ত চিঠি দেয়া হয়েছিল।
যা মূল প্রার্থীর জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৈরি করেছে বিব্রতকর পরিস্থিতি। কর্মীরা বুঝতে পারেনি কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দের প্রার্থী। যার কারণে একক প্রার্থীর প্রতি তৃণমূল নেতারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগই পাননি।
আইনগত জটিলতায় পড়তে পারেন জেনেও তারা ডজন ডজন আসনে প্রার্থী করেছেন পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের। জটিলতায় পড়ছে দেখেও দ্রুত বিকল্প প্রার্থী দিতে পারেনি। তাই শতাধিক আসনের প্রার্থীকে গণসংযোগের চেষ্টার চেয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে উচ্চ আদালত থেকে নির্বাচন কমিশনে।
বহু আসনে জনপ্রিয়, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের বদলে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল অখ্যাতদের। কিছু আসনে দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে সংশ্লেষ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কহীন নেতার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল ধানের শীষ প্রতীক। মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্নও মনোনয়ন বোর্ড এড়াতে পারেননি।
মনোনয়ন বোর্ডের কয়েকজনের বিরুদ্ধে এ বাণিজ্যের অভিযোগ এখন সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। অর্থের বিনিময়ে প্রাথমিক মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন অনেকেই, যাদের অনেকেই হাসিল করেছে চূড়ান্ত মনোনয়ন। যা সংশ্লিষ্ট আসনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে এবং যার প্রেক্ষিতে তারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন নির্বাচনে।
জামায়াত নেতাদের হাতে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া ছিল বিএনপির আরেকটি বড় ভুল। যা তাদের প্রতিকূলে খুলে দিয়েছে অপপ্রচারের আরেকটি জানালা। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণায় বলেছিল, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু সেটা কেমন আন্দোলন ছিল, সে আন্দোলনের ধরন কেমন ছিল, ফলাফল কি হলো, ভবিষ্যৎ কি সে সম্পর্কে তারা দেশ ও জাতির সামনে কিছুই পরিষ্কার করতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ও ঐক্যের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে প্রচলিত একটি কথা হচ্ছে- ‘আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল একই সুরে কথা বলে’। এটা নিশ্চিতভাবেই একটি দলের সাংগঠনিক ভিত্তির নির্দেশক। সাংগঠনিক ভিত্তির প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান কোথায়? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রায়ই বলেন, ক্লাব মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিএনপি।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল- সর্বস্তরেই দলটি পরিচালিত হচ্ছে অপূর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মাধ্যমে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের স্থায়ী কমিটির পরিধি বাড়িয়ে ১৫ থেকে উন্নীত করা হয়েছিল ১৯-এ। কিন্তু দুইটি পদ শূন্য রেখেই সে কমিটির পথচলা শুরু হয়। পরবর্তীতে মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হয় আরো তিনটি পদ। নীতিনির্ধারক ফোরামের দুই নেতা আগে থেকেই দেশান্তরে পড়ে আছেন আইনি জটিলতায়।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর শূন্য (সশরীরে অনুপস্থিতি) হয়েছে আরো তিনটি পদ। বার্ধক্যজনিত কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ দূরের কথা ফোরামের বৈঠকেই অনুপস্থিত থাকেন কয়েকজন। ফলে দলটির সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাপ পড়ছে অপূর্ণ নীতিনির্ধারক ফোরামের কয়েকজনের ওপর। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মী তৈরির সূতিকাগার ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের কোনো তৎপরতা নেই।
ছাত্রদলের নেতৃত্ব বুড়োদের দখলে। দুইবছর আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়া কমিটির শীর্ষ নেতাদের বয়স ৩৫-৪৫-এর মধ্যে। যাদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই ক্যাম্পাসের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, দীর্ঘ ২৮ বছর পর যখন ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তখন ভবিষ্যৎ শঙ্কায় সেখানে অনাগ্রহ পোষণ করেছেন আগামী কমিটিতে পদপ্রত্যাশী সংগঠনটির মাঝারি নেতারা। তারা আশঙ্কা করছেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিয়মিত ছাত্ররা আলোচনায় উঠে এলে আগামী কমিটি গঠনে তারা বাদ পড়তে পারেন।
ব্যক্তিস্বার্থের জন্য এমন আত্মঘাতী অবস্থান তাদের। যদিও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম। একই পরিস্থিতি অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনেও। প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু সেগুলোকে সচল করার কোনো উদ্যোগও নেই তাদের।
দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতার আরেকটি কারণ সকল পর্যায়ে কমিটি গঠনে সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার বদলে গুরুত্ব পায় ব্যক্তিস্বার্থ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলের একাংশকে কোণঠাসা করে নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয় অন্যাংশের হাতে। আর প্রতিবার কমিটি গঠনেও উঠে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ।
অনেক ক্ষেত্রে তার প্রমাণ পাওয়ার পর সে ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্ব কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা পদের বিনিময়ে অর্থ আদায়কে পরিণত করেছে রেওয়াজে। এ ছাড়া ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি। বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটি গঠনের কথাটি রয়ে গেছে কাগজে কলমে।
প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেয় বিএনপি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরও পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন নীতিনির্ধারকদের কয়েকজন। তবে দলটির এমন মনোভাব নিয়ে সন্তুষ্ট নয় তৃণমূল।
তারা বলছেন, বড় বড় সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় নেতারা, আন্দোলন-সংগ্রামে তারা নিষ্ক্রিয় থাকেন, সুযোগ পেলে কেবলা পরিবর্তন করেন, সময় মতো ফিরেও আসেন এবং বাণিজ্যের অভিযোগও উঠে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতিটি বিপর্যয়ের পর দলকে চাঙ্গা করার নামে কপাল পোড়ে তৃণমূলের। দুর্দিনে যারা দলকে ধরে রাখে তাদেরই বাদ দেয়া হয় পুনর্গঠনে।
নির্বাচনে ব্যর্থতার পর দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের দুই সদস্য ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে নিজেরা সরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি ব্যর্থ নেতৃত্বের সরে দাঁড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। তারা মূলত দলের মহাসচিবসহ নীতিনির্ধারকদের দিকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলেছিলেন। কিন্তু সেটাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা করে প্রচার করা হয় কৌশলে। মহাসচিব তার বক্তব্যে বলেন, ‘দল ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে সামনে রেখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের আবেগ উস্কে দিয়ে ব্যর্থরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করে নিচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহাসচিব হিসেবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইদিকই রয়েছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। মার্জিত ব্যবহার, সজ্জন ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী হিসেবে রাজনীতিতে তার গ্রহণযোগ্যতা ভালো। কিন্তু তিনি কতটুকু সাংগঠনিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। দীর্ঘ এক দশক মহাসচিব হিসেবে সাংগঠনিক সফরকে গুরুত্ব দেননি তিনি। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি তিনি। দলের কেন্দ্রীয় ও মাঝারি পর্যায়ের কিছু নেতা তাদের কাজেকর্মে বারবার প্রমাণ করেছেন ব্যক্তিস্বার্থই তাদের কাছে সবকিছুর উপরে।
পঞ্চম জাতীয় সংসদে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। কিন্তু শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শরিক হয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের টানা আন্দোলনে।
সপ্তম সংসদের শেষদিকে এসে তারা আবার বিএনপির নেতৃত্বেই গড়েছিল নির্বাচনী জোট। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সে জোট ফলপ্রসূও হয়েছিল। কিন্তু ওয়ান ইলেভেন থেকে দুই দলের ভেতরকার ঐক্য ফাটল ধরে। দিনদিন সে ফাটল বাড়লেও অদৃশ্য কারণে তার চূড়ান্ত রূপ নেয়নি।
জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়া ও জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী করে গাড়িতে পতাকা উড়ানোর সুযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের অপ্রিয় হয়ে উঠে বিএনপি। জামায়াতের কারণে দেশে-বিদেশে হতে হয় অপপ্রচারের শিকার। একযুগ ধরে হজম করতে হয় সরকারসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত চাপের মুখেও রহস্যময় আচরণকারী জামায়াতের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বিএনপি।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন ছিল কৌশলে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন বা দৃশ্যত সম্পর্ক ছিন্ন করে ভেতরগত ঐক্য ধরে রাখার। কিন্তু কোনোটিই করতে পারেনি তারা। বরং জামায়াত নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন নীতিনির্ধারক নেতারা।
ভোটের পর ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু নতুন নির্বাচনের দাবি আদায় বা এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে তাদের চেষ্টা কতটুকু সফল হবে? চারদিকে কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্কই তৈরি হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে বিএনপির বন্ধুত্বের বিষয়টি ছিল রাজনীতির এক প্রচলিত ও বিশ্বাস্য বিষয়।
কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাইওয়ানকে বাণিজ্য কেন্দ্র খুলতে দেয়ার মধ্যদিয়ে বিএনপির ওপর থেকে চীন যেভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তার উন্নতি ঘটেনি বিগত দেড়যুগেও। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি চীনের সমর্থন ছিল একচ্ছত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী ভারতের আস্থা অর্জনেও সফলতা দেখাতে পারেনি বিএনপি। সহসা বিষয়টির উন্নতির কোনো লক্ষণও দেখছেন না রাজনৈতিক মহল।
বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি রয়েছেন। দলের যেকোনো বিষয়ে তার মতামত নেয়া সহজ নয়। তার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া আত্মীয়-স্বজনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে নেতাদের। কিন্তু রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এমন কিছু ইঙ্গিত আছে যা অরাজনৈতিক আত্মীয়-স্বজনের বোঝার কথা নয়। তার ওপর খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয় সপ্তাহে একবার। আইনি জটিলতার কারণে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পরামর্শ দেয়ার সুযোগও নেই তার।
অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবস্থান করছেন লন্ডনে। তিনিও চেয়ারপারসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বা আলোচনার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে তাকে দলের সিনিয়র নেতা ও বিশ্বস্ত সূত্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এখানে নেতাদের যেমন তাকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ থাকছে, তেমনি তার বিশ্বস্ত সূত্রগুলো ছিল বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একবছর ধরে কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন প্রায় এক যুগ ধরে।
তিন মামলায় সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেকের ফেরার কোনো আশা দেখছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। আবার দলের স্থায়ী কমিটির অর্ধেক শূন্যতার কারণে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কয়েকজনকেই। তারপরও দলের নীতিনির্ধারক ফোরামটি পূর্ণ ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছে না বিএনপি। বিএনপির আরেকটি দুর্বলতা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা। প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্বসহ নীতিনির্ধারক ফোরাম। সাংগঠনিক পুনর্গঠন থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই এ দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে বারবার।
এমনকি কিছু বিষয়ে একটি বিবৃতি দিতেও তারা সময় নেন। ক্ষমতাসীনদের বিবৃতি বা পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করে তারা অবস্থান ঠিক করেন। যেমন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষতিগ্রস্তদের দুয়েকজন ছাড়া অন্যদের খবর নেয়ার তৎপরতাই দেখা যায়নি তাদের। সুবর্ণচরে ধর্ষিতাকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে ছিলেন। এ ছাড়া এটা বারবার প্রমাণ হয়েছে যে, বিএনপি নেতারা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ভুল সংশোধনে বিশ্বাসী নয়। এ ছাড়া নিজেরা কোনো ইস্যু তৈরি করে সরকারকে চাপে ফেলতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন দলটির নেতারা। বরং সরকার যে ইস্যু তৈরি বা সামনে আনে এবং সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেয়াই হয়ে পড়েছে দলটির অভ্যাসে।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর মধ্যদিয়ে যে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছিল তার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে। মামলার কারণে তৃণমূল নেতাদের একটি বড় অংশই আগে থেকে এলাকাছাড়া।
আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। পালিয়ে পালিয়ে কতদিন এ দলের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে পারবেন তারা? কারণ মামলা ও গ্রেপ্তার কৌশলে বিএনপিকে বাস্তবিক অর্থেই কোণঠাসা করে ফেলেছে সরকার। কেবল আন্দোলনই নয় নির্বাচন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু সামনে এলেই হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করে আসছে সরকার।
মামলাগুলোর একাংশ এখন বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষপ্রান্তে। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই নেতাদের সাজা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। আর গণ্ডা গণ্ডা মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা।
অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা রাজনীতির মাঠে কতদিন টিকে থাকতে পারবে সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো একটা দলের মধ্যে যখন হতাশা থাকে, নেতৃত্বশূন্যতা থাকে, তখন ধীরে ধীরে দলটির উপযোগিতা কমে যায়।
বার্তা কক্ষ
৪ জানুয়ারি, ২০১৯