লাইফস্টাইল

বিসিএস পুলিশ দম্পতির চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প

তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ৩৩তম বিসিএসের ফল প্রকাশের পর। সেদিন ফল প্রকাশ পরবর্তী ক্যাডারদের সমাবেশে গিয়েছিলেন তারা দু’জন। সেখানে প্রথমে চোখাচোখি। তারপর সামান্য কথা।

এর কয়েকদিন পর শুরু হয় পেশাগত প্রশিক্ষণ। কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে হওয়া সেই প্রশিক্ষণে সামান্যই দেখা হতো তাদের। যে দেখায় থাকতো মিষ্টি চোখের দুষ্টুমিতে অব্যক্ত এক আবেদন। বুক ধড়ফড় করা সেই মুহূর্তগুলো বেশ উপভোগ করতেন দু’জনেই। এভাবেই একসময় তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। তারপর পরিবারের সিদ্ধান্তে সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিংয়ের ১১ মাসের মাথায় তারা বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। ২০১৫ সালের ১৭ জুলাই।

বলছি এক পুলিশ দম্পতির জীবনের গল্প। যে জীবনে আছে কঠিন থেকে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ, আছে জনগণের সেবা করার অফুরন্ত সুযোগ। আরো আছে মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা।

এই পুলিশ দম্পতির একজন মো: জাহিদুল ইসলাম সোহাগ। আরেকজন শামীমা আক্তার সুমী। বরগুনার ছেলে জাহিদ আর শরীয়তপুরের মেয়ে সুমী। দু’জনেই ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পান। জাহিদ কাজ করছেন, কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে। আর সুমী আছেন পুলিশের বিশেষ শাখায়, মালিবাগে।

ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র সব জায়গাতেই এ দম্পতির জন্য অপেক্ষা করে চ্যালেঞ্জ। আর সেসব চ্যালেঞ্জকে জয় করেই আজ তারা সফল মানুষ, সফল দম্পতি। কোনো বাধাকে বাধা মনে না করে সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেন তারা। একই পেশায় হওয়ায় একজন অন্যজনকে সহযোগিতাও করতে পারেন।

পুলিশের চাকরিতে থাকার কারণে দু’জনকেই চ্যালেঞ্জিং এ পেশায় পেরুতে হয় নানা চড়াই-উৎরাই। সেখানে মজার মজার নানা অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাদের ঝুলিতে। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন সুমী।

সুমীর বলছিলেন, ‘আমাদের যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তখন আমার দাদী বাবা-মা কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছেলে কী করে। বাবা-মা যখন বলেছিলেন ছেলে এএসপি। তখন দাদী বলেন, আমাদের মেয়েও তো এএসপি। তাহলে আমরা ওকে কেনো আবার এএসপি’র কাছে বিয়ে দিবো? সরাসরি এসপি’র সাথেই না বিয়ে হবে ওর।’

ছোট থেকেই বাবার স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন সুমী। পুলিশের একজন সদস্য হওয়ায় বাবা চাইতেন তার তিন সন্তানের মধ্যে কেউ একজন বাংলাদেশ পুলিশে আসবে। ভাই-বোনদের মধ্যে সুমী ছিলেন সবার ছোট। অন্য দু’ভাই বাবার স্বপ্নের পথে না হাঁটলেও সুমীই পূরণ করেছেন বাবার স্বপ্ন।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ থেকে বিএসসি সম্পন্ন করা সুমী বাবার চাকুরির সুবাদে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছেন প্রায় ১১ টি স্কুলে। ছোট থেকেই মেধাবী হওয়ায় ফলাফলের দিক দিয়ে সবসময় থাকতেন এগিয়ে। অার তাই বিসিএসের ক্ষেত্রেও ঘটেনি তার ব্যতিক্রম।

পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও এ পেশাকে বেশ উপভোগ করেন সুমী। সংসারে বেশি সময় দিতে না পারলেও যে স্বল্প সময়টা পরিবার ও সন্তানকে দিতে পারেন সেটুকুই অনেক বেশি উপভোগ্য মনে হয় তার। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন স্বামী-সন্তানের সাথে।

তবে এক্ষেত্রে এ দম্পতির দু’জনেই বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তাদের এ সফলতার পেছনে পরিবারের অবদানের কথা। তাদের ছোট্ট শিশু জাহিনকে দেখে রাখার জন্য পালা করে থাকেন তাদের শাশুড়িরা। তার এ পেশায় আসার পেছনে নিজের ভাবীর অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন সুমী।

দু’জনেই পুলিশে চাকরি করেন- বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন স্বজনরা? এ প্রশ্নের উত্তরে সুমী হেসে বলেন: দু’জনেই পুলিশ হওয়াতে গ্রামের সবাই অনেক বেশি প্রভাবশালী মনে করে আমাদের। তাদের ধারণা, আমরা চইলেই অনেক কিছু সম্ভব। তাদের কখনোই বোঝাতে পারি না যে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সামান্য কর্মচারি মাত্র।’

তবে গ্রামে গেলে পুলিশে নিজেদের অবস্থানটা বোঝাতেও বেশ বেগ পেতে হয় এ দম্পতিকে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, গ্রমের মানুষ ওসি-দারোগা পর্যন্তই বুঝতে পারে। তার ওপরে কিছু বলতে গেলে অনেক বিস্তারিত বোঝাতে হয় তাদের। তবে সবারই ধারণা জাহিদ নিশ্চয়ই সুমীর চেয়ে বড় পোস্টে চাকুরি করে।

ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ হিসেবে পরিচিত জাহিদ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্পন্ন করেছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হওয়ার সুবাদে খুব সহজেই পেয়ে যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগ। সেখানে শিক্ষকতা করার সময়ই সফল হন বিসিএস-পুলিশ ক্যাডারে।

জাহিদ বলেন: ‘ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল পুলিশ হওয়ার। আমার স্বপ্নের সাথে যদি বাস্তবে কিছু পেয়ে থাকি সেটা হলো বিসিএস-পুলিশ ক্যাডারে সফল হওয়ার বিষয়টি।’

জীবনে মাত্র একদিন বেকার থেকেছেন জাহিদ। ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি অব্যাহতি দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদ থেকে। তার ঠিক একদিন পর ৭ আগস্ট যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। ট্রেনিংয়ে ১৪৭ জন কর্মকর্তাকে পেছনে ফেলে অর্জন করেন দ্বিতীয় স্থান।

বুঝতে শেখার পর থেকেই জাহিদের স্বপ্ন ছিল পুলিশের চাকরি করার। আর এজন্য করেছেন কঠোর অধ্যবসায়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের মতো পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় কাজ করতে পেরে গর্বিত এ কর্মকর্তা।

তবে পুলিশের গুটিকয়েক কর্মকর্তার কারণে পুরো পুলিশ বিভাগের সুনামহানির বিষয়টা মোটেও মেনে নিতে পারেন না তিনি। বিশ্বাস করেন, পুলিশের অবস্থান এখন আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা সবকিছুতেই দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে পুলিশের দক্ষতা।

নাটক সিনেমায় পুলিশের রোলকে যেভাবে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থপন করা হয়; সে বিষয়েও এ কর্মকর্তার ঘোর আপত্তি। এ জন্য অবশ্যই আইন থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ পুলিশকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাবার যেখানে সন্ত্রাসীরা পুলিশের নাম শুনলে ভয় পাবে। সংবিধানে সবার স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করতে চান জাহিদ। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে এমন অবস্থানে নিয়ে যেতে চান যেখানে রাত তিনটার সময়ও যাতে পুরুষের মত নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন নারীরা।

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এ দম্পতি বলেন: আত্মবিশ্বাসটা প্রয়োজন সবার আগে। যে যেতো বেশি আত্মবিশ্বাসী, সে ততো বেশি এগিয়ে থাকবে এই প্রতিযোগীতায়। আর প্রয়োজন অধ্যবসায় এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অনুগত্য। তাহলেই সফলতা আসবে।-চ্যানেল আই
(এমটিনিউজ২৪.কম)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪: ০৫ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার
এএস

Share