‘আমাদের জীবনাচার, সামাজিকতা, পরিবার হারিয়ে ফেলেছি। শুধু প্রতিবেশী নয়, পরিবারের স্বজনরাও আমাদের সঙ্গে পশুসুলভ আচরণ করে। দূরে সরিয়ে রাখে।
আমার স্বামীর কাছ থেকেই এ মরণব্যাধি আমার শরীরে সংক্রামিত হয়েছে। আমার গর্ভের দুই সন্তানও এ রোগে সংক্রামিত।’ গাজীপুর জেলার এক নারী এভাবেই জানালেন নিজের ও দুই মেয়ের অসহায়ত্বের কথা। অধিকাংশ এইচআইভি আক্রান্তরা সামাজিক সহায়তা বা সহানুভূতি পান না।
আক্রান্তরা সরকার থেকে অ্যান্টিরেক্ট্রো ভাইরাল (এআরভি) ড্রাগসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলেও, তাদের জন্য ভালোবাসা জরুরি।
আজ ‘বিশ্ব এইডস দিবস’। বৈষম্যহীন এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিতকরণের অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি উদযাপিত হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘এইচআইভি পরীক্ষা করুন, নিজেকে জানুন।’
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন- সরকার স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে এইডস আক্রান্তদের বিনামূল্যে ওষুধ ও সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে।
বর্তমানে এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশব্যাপী ২৩টি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আমি এইডস প্রতিরোধ ও নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন- এইচআইভি প্রতিরোধের সব কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থা, মাদক বর্জন, নৈতিকতার উন্নয়ন, ধর্মীয় অনুশাসন এবং আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্যহীনতা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের চলমান কার্যক্রমগুলো গুণগত মানোন্নয়নর মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে হবে।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্য খাতের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আমি ‘বিশ্ব এইডস দিবস-২০১৮’ উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন ১৯৮৯ সালে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। এখনও শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছেন ৭ হাজার ৪১৪ জন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নতুন করে ৮৬৫ জন এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। আর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৮৬ জন। গত বছরের চেয়ে নতুন রোগী বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন করে ২৮৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত দেশে ৯২৪ জন আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এখনও পর্যন্ত সাধারণ জনগণের মধ্যে সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক ০১ ভাগের নিচে।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন- শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, সমকামী ও হিজড়াদের মধ্যে সংক্রমণের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইবিবিএস-২০১৬ : আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় শিরায় মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ২২ শতাংশ। শুধু গত এক বছরে (নভেম্বর ২০১৭-অক্টোবর ২০১৮) ৮৬৫ জন নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত করা হয়।
যাদের মধ্যে ৩০ শতাংশই বিদেশ ফেরত অভিবাসী। যাদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী। স্বাস্থ্য অধিদফতরের টিবি-লেপ্রোসি ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে বোঝা যায়- গত এক বছর নতুনভাবে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে সর্বোচ্চ ৯০০ জনের মতো। তবে মৃতের সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় কমে এসেছে।
জাতীয় এইডস এসটিডি কর্মসূচি কট্রোল প্রোগ্রাম স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. বেলাল হোসেন যুগান্তরকে জানান, ঢাকা শহরে ৬টি এবং ঢাকার বাইরে আরও ১৯টি সেন্টারের মাধ্যমে আক্রান্তদের এআরডি ড্রাগস দেয়া হচ্ছে। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আক্রান্ত মা ৯১টি শিশু জন্ম দিয়েছেন যাদের মধ্যে মাত্র ১টি শিশু আক্রান্ত হয়েছে।
বাকি ৯০টি শিশু সুস্থভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। আক্রান্ত মায়েরা ওষুধ সেবন করলে জন্মের শিশুরা এইডস মুক্ত হতে পারে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট সফলতা। বিশ্বে যেখানে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ২৫.২৮ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১.০৯ শতাংশ।
তিনি বলেন, এ বছর রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন করে ২৮৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যাদের মধ্যে হিজড়া রোহিঙ্গাও রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম সম্প্রতি ইউএন এইডসের ৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে।
যার অর্থ সম্ভাব্য ২০২০ সালের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তদের ৯০ শতাংশকে শনাক্তের আওতায় আনা। শনাক্তকৃতদের মধ্যে ৯০ শতাংশকে চিকিৎসা সেবার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং চিকিৎসা সেবায় থাকা ৯০ শতাংশের ভাইরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখা।
নির্ধারিত সময়ে ইউএন এইডসের ৯০-৯০-৯০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে টিবি-লেপ্রোসি ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কর্মসূচি : ১৯৮৮ সাল থেকে এ দিবসটি সারা পৃথিবীতে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি দেশের প্রতিটি জেলা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
প্রতিটি জেলায় সিভিল সার্জন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকদের নেতৃত্বে দিবসটির তাৎপর্য ব্যাখ্যাপূর্বক আলোচনা সভা ও র্যালি করা হবে। ঢাকায় বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তন, ফার্মগেটে। সকাল সাড়ে ৯টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে।(যুগান্তর)
বার্তা কক্ষ
০১ ডিসেম্বর,২০১৮