আজ ১২ অক্টোবর বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস। ১৯৯৬ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড আরথ্রাইটিস ডে’ দিবসটি ‘আর্থ্রাইটিস অ্যান্ড রিউমেটিজম ইন্টারন্যাশনাল’-এর তত্ত্বাবধানে উদ্যাপিত করে আসছে। বহু প্রাচীনকাল থেকে এ রোগটির অস্তিত্ব থাকলেও ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই এটি পুস্তক বা নথিবুক্ত হওয়া শুরু করে এবং আকারে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে এবং সংক্রমিত হতে শুরু করে।
১৮৫৯ সালের দিকে রোগটিকে তার বর্তমান ‘আর্থ্রাইটিস’ নামকরণ করা হয় ।
‘আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশন’ আটল্যান্টা’-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মানুষের অক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো আর্থ্রাইটিস। বর্তমানে শুধু আমেরিকাতেই সাত মিলিয়নের বেশি লোক এখন আরথ্রাইটিসে আক্রান্ত। আমাদের দেশে প্রায় ২৫ % মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বাত ও জটিল বাতরোগে আক্রান্ত।
আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারণত গিরার প্রদাহ বোঝানো হয় যা সন্ধিবাত নামেও পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, ‘আর্থ্রাইটিস’ একক রোগ নয়; এটি অনেকগুলো রোগের প্রধান লক্ষণ। আরথ্রাইটিস বহু ধরনের হতে পারে। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে আলাদাভাবে দ ুটি গবেষণা চালানো হয় যেখানে আরথ্রাইটিসের ১০০ রকমের প্রকার উল্লেখ করা হয়।
প্রদাহের কারণভেদে এ রোগটিকে সাধারণত অস্টিও আর্থ্রাইটিস, ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আর্থ্রাইটিস যার মধ্যে রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, গাউট, সংক্রমণজনিত আর্থ্রাইটিস, জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি দলে শ্রেণিভুক্ত করা হয়ে থাকে।
পশ্চিমা বিশ্বে রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিসবেশি দেখা গেলেও আমাদের দেশে অস্টিওআর্থাইটিস এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, যা পুরুষদের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি। সর্বোপরি ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আর্থ্রাইটিস মহিলাদের বেশি আক্রান্ত করে থাকে।
ইনফ্লামেটরি বা ওটোইম্যুন আরথ্রাইটিসের প্রধান লক্ষণগুলো হলো অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যথা, জয়েন্ট ফুলে যাওয়া ও শক্ত হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া এ রোগের অন্য উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাতকালীন জড়তা, চলাফেরায় জড়তা, মাংসপেশিতে ব্যথা, জয়েন্টের ফ্লেক্সিবিলিটি কমে যাওয়া।
প্রকারভেদে ভিন্ন ভিন্ন আর্থ্রাইটিস বিভিন্ন জয়েন্টকে আক্রান্ত করে থাকে। রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রধানত দুই হাত বা পায়ের ছোট ছোট পাঁচ বা তার অধিক জয়েন্টকে আক্রান্ত করে থাকে। এ ছাড়া যেসব সন্ধিতে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, সেগুলো হলোÑ হাঁটু, কনুই, রিস্ট ও সোল্ডার জয়েন্ট। আরথ্রাইটিসে চিকিৎসা না নিলে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে জয়েন্ট ডিফরমিটি বা বিকৃতি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস নামক রোগে প্রধানত মেরুদে র জয়েন্টগুলো আক্রান্ত হয়। যা সাধারণত ৪৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত রোগীরা ইনফ্লামেটরি ব্যাক পেইন নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন।
এ ব্যথা সাধারণত বিশ্রামে, ভোররাত বা সকালে বেশি থাকে এবং হাটাচলা বা কর্মকাে র ফলে উন্নতি হয়। এ ছাড়া এ আরথ্রাইটিসে পেটের প্রদাহ, এক বা দু’ চোখ লাল হয়ে দেখতে অসুবিধা হতে পারে এটা সাধারণত ইউভাইটিস, লিগামেন্ট বা মাংসের টেন্ডন হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকে, সেখানেও প্রদাহ হতে পারে; যেটিকে এন্থেসাইটিস, চর্মের বা নকের সোরিয়াসিস রোগের ইতিহাস থেকে থাকে। যেসব সন্ধিতে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে সেগুলো হলো হাঁটু, হিপ, কোমর, ঘাড়, হাত ও পায়ের আঙুল, কনুই, রিস্ট প্রভৃতি।
অস্টিও আর্থ্রাইটিস আরেকটি খুব সাধারণ বাত। আমাদের জয়েন্টের ভেতরে হাড়ের শেষ প্রান্তে কার্টিলেজ নামক এক ধরনের অংশ থাকে, যা অস্থিসন্ধিকে ফ্লেক্সেবল রাখে এবং জয়েন্টের অতিরিক্ত চাপ বা প্রেসার শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। কোনো কারণে এ কার্টিলেজ নামক পদার্থটি যদি ক্ষয় হয়ে যায়, তখন তা আরথ্রাইটিসের রূপ নিতে থাকে।
জয়েন্ট মার্জিনে নতুন হাড় তৈরি হয়। আর্থাইটিসের তীব্রতা ও ধরনের ইনজুরি ও ক্ষয় হওয়ার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত যারা অধিক ভারী কাজ করে বা যাদের ওজন বেশি, তাদের ক্ষেত্রে জয়েন্টের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বয়সের কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়েন্টের ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে কার্টিলেজ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয় এবং জয়েন্টের দু দিকে হাড়ের ঘর্ষণে ব্যথা হয়। এই রোগে সাধারণত হাঁটু বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়।
মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং জয়েন্ট নাড়াচাড়া করলে মুড়মুড় শব্দ করা, হাঁটু বাইরের দিকে বেঁকে যাওয়াও এই রোগের অন্যতম উপসর্গ। জয়েন্টে ক্রমাগত আঘাত লাগা বা অপারেশন করা, জয়েন্ট ইনফেকশন হওয়া, বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি, রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
ওজন হ্রাস এবং ব্যায়াম এবং শারীরিক থেরাপি আর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। সবশেষে বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবসটির প্রতিপাদ্য মাথায় রেখে এটা বলা যায়, আরথ্রাইটিসের চিকিৎসার দ্রুত গ্রহণ করলে এই রোগের সঠিক নিয়ন্ত্রণ এবং অনেকাংশে রোগীর কার্যক্ষমতা এবং জীবনযাপনের মান রক্ষা করা যায়।
বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্র রিউমাটোলজি বিভাগ চালু আছে। সারা দেশের এতগুলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোথাও রিউমাটোলজি বিভাগ নেই। অথচ, আমাদের দেশে এখন দীর্ঘ পাচ বছর এই বিষয়ে পড়াশোনা করে পাস করে বসে আছেন প্রায় ৪০ জন রিউমাটোলজি বিশেষজ্ঞ।
পদ ও কাজের পরিবেশ না থাকায় তাদের মেধা ও কর্মদক্ষতা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারছেন না। তাই অনতিনবিলম্বে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিউমাটোলজি বিষয়ে পদ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বার্তা কক্ষ , ১২ অক্টোবর ২০২০
এজি