একজন ডাক্তার সায়েবা আখতার। বুঝতে শেখার পর নিজে স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষক হবেন। কিন্তু তার শিক্ষক বাবার স্বপ্ন মেয়ে ডাক্তার হবে। শেষ পর্যন্ত নিজের স্বপ্নকে ছাইচাপা দিয়ে বাবার স্বপ্নকে লালন করতে থাকেন। শিক্ষক আর হয়ে উঠা হয়নি তার। বাবার ইচ্ছায় চিকিৎসা শাস্ত্রেই লেখাপড়া করতে হলো। অবশ্য তিনি এজন্য গর্বিত।
বলেন, সেদিন বাবার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। বাবা যদি আমাকে মেডিকেলে ভর্তি না করতেন আমি আজ এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না । একুশে পদক বিশাল সম্মানের। এ পদক আমার দায়িত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার এ সফলতার জন্য আমি আমার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ । আমার পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে আমি আমার রোগীদের কাছে কৃতজ্ঞ।
গণমাধ্যমের কাছে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার। ডাঃ সায়েবা আখতার বলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে রক্ত ক্ষরণে মায়ের মৃত্যু আমার কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য মনে হতো না। যে সমস্ত রোগী রক্তক্ষরণে মারা যায় তারা হাসপাতালে যখন আসে তখন সুস্থ থাকে।
একজন প্রসূতি সুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আসলো বাচ্চা হওয়ার পর রক্তক্ষরণে মারা গেল? আমরা এতজন ডাক্তার কিছুই করতে পারলাম না। এটা আমার কাছে খুব অপরাধবোধ হতো। কেন আমরা কিছু করতে পারছিনা? বিদেশে তো রক্তক্ষরণ বন্ধে বেলুন ব্যবহার করে। তবে এটা খুব ব্যয়বহুল। একবার একটা প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ডের এক ডাক্তার একটা বেলুন নিয়ে এসেছিলেন এর ব্যবহার দেখাতে। তখন আমি তার কাছ থেকে বেলুনটা রেখে দিয়েছিলাম । এরপর কয়েকজন রোগীর ক্ষেত্রে বেলুনটি ব্যবহার করেছিলাম। যদিও একটি বেলুন একটি রোগীর জন্য। তারপরও সেভলন দিয়ে ধুয়ে আমরা বেলুনটিকে একধিকবার ব্যবহার করেছি। একসময় বেলুনটি হারিয়ে যায়।
২০০০ সালের কথা- ১৮ বছরের একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে রক্তক্ষরণে আমার চোখের সমানে মারা গেল। আমরা এতগুলো ডাক্তার এত চেষ্টা করলাম কিন্তু মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলাম না। সারা রাত আমার ঘুম হলোনা। শুধু মনে হচ্ছিল মেয়েটার জীবন শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল। কত স্বপ্ন নিয়ে সে হাসপাতালে এসেছিল। হঠাৎ মনে হলো গ্রামে-গঞ্জে ছোট ছেলে-মেয়েরা কনডম কিনে ফুলিয়ে খেলা করে। কনডম ফুলিয়ে যদি জরায়ুর মধ্যে স্থাপন করা যায় তাহলে হয়তো রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যাবে। কিন্তু কনডমের ধারন ক্ষমতা কতটুকু সেই সম্পর্কে আমার কোন ধারনা ছিল না।
পর দিন আমি ওটিতে গিয়ে এক লিটার পানি ঢুকালাম কনডমের মধ্যে। তারপর এটাকে ফাটানোর চেষ্টা করলাম ফাটাতে পারলামনা। আমার সহকারীদের বললাম দেখতো এটাকে ফাটাতে পারো কিনা? তারাও পারলো না। আমি দেখলাম কনডমের ধারন ক্ষমতা অনেক ভালো। এটা দিয়ে হবে। এর দুই একদিন পর আমি ওটিতে গিয়ে খোজ নিলাম কোনো রোগী আছে কিনা । ডাক্তাররা বললো একজন রোগী আছে তার খুব রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। তার জীবন রক্ষায় জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। আমি বললাম দাঁড়াও আমি আসছি। তাৎক্ষণিক একজন ইন্টার্নিকে বললাম তুমি দৌড় দিয়ে এক প্যাকেট কনডম নিয়ে আসো। তারপর কনডমটা একটা ক্যাথেটার দিয়ে বেঁধে আমি রোগীর জরায়ুতে ঢুকিয়ে ক্যাথেটারের মাধ্যমে স্যালাইন দিয়ে কনডমটা ফুলালাম। সঙ্গে সঙ্গে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেল। ইউরেকা । এটা দিয়ে কাজ হবে ইনশাল্লাহ। তারপর আমার মনে হলো গবেষণা না করলে এপদ্ধতিটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০২ সালের জুন পর্যন্ত আমরা গবেষণা করলাম। এই দেড় বছরের গবেষনায় যতগুলো রোগীর উপড় এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি প্রতিটিতে আমরা সফল হলাম। তারপর আমার এই পদ্ধতিটা একটি ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশ করলাম। এটা প্রকাশ হওয়ার পরেই বিভিন্ন দেশে যারা মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে তাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো।
এরপরে এশিয়া আফ্রিকার অনেক দেশেই এটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এবং ভালো ফল পাওয়ায় এখন সেসব দেশে এটি ব্যবহার হচ্ছে। সায়েবাস মেথড নামটি কার দেয়া? জানতে চাইলে ডাঃ সায়েবা বলেন চিটাগাং মেডিকেল কলেজের অবসটেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকলজি সোসাইটির একটি কনফারেন্স ছিল। সেখানে আমি আমার মেথডটা উপস্থাপন করি । সেখানে সবাই আমাকে বলছিল এই মেথডটার নাম কি। আমিও বললাম কি নাম দেয়া যায়। তখন যিনি গাইনির হেড অব ডিপার্টমেন্ট ছিলেন প্রফেসর তায়েব খান তিনি বললেন এটা সায়েবার মাথা থেকে বের হয়েছে তাই এর নাম সায়েবাস মেথড। তখন সবাই বললো এখন থেকে এর নাম সায়েবাস মেথড।
সারা বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। এর ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ। ‘সায়েবাস মেথড’ নামের এই পদ্ধতি আজ অজস্র নারীর জীবন বাঁচানোর এক মোক্ষম উপায় হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সায়েবা আখতার বলেন আমার এখন পরিকল্পনা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ফিস্টুলা নির্মূল করা । আমি তো একা পারবোনা। সরকারের সহযোগিতায় এক সঙ্গে কাজটি করতে চাই। রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেনস হেলথ নামে একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিউট আছে আমার ভাড়া করা জায়গায়। সরকার যদি আমাকে সাহায্য করে একটি জায়গা দেয়। আমি বড় আকারে একটি ইন্সটিটিউট করতে পারবো। প্রসবজনিত সকল সমস্যার চিকিৎসা এবং ট্রেনিং দেয়া হয় আমার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। আমাদের দেশের মায়েরা প্রসবজনিত এত সমস্যায় ভোগেন অথচ লজ্জার কারণে অনেকেই বলতে পারেনা।আমরা যখন বলা শুরু করবো তখন তাদের সংকটটা কেটে যাবে ।
এ বিষয়টি নিয়ে জন সচেতনার আরো দরকার আছে। আর মেয়েদের যদি আমরা শিক্ষিত করতে পারি তাহলে পুরো জাতিটা শিক্ষিত হয়ে যাবে। মেয়েদের লেখাপড়া করা দরকার । মেয়েদের পায়ের নীচের মাটি শক্ত হওয়া দরকার। দুস্থ মেয়েদের শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে ঢাকা গাইবান্ধায় আমার দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে।আমি চাই মেয়েরা যেন স্বাস্থ্য সচেতন হয় তারা যেন রোগ না লুকায় বা গোপন না করে ।
বাংলাদেশী স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সায়েবা আক্তার ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সার্জনসের একজন নির্বাহী সদস্য এবং এর আগে বাংলাদেশের অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গাইনোকোলজি সোসাইটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা এবং গাইবান্ধায় দুটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে।
তিনি ‘সায়েবা’স মেথড’ (সায়েবার পদ্ধতি) নামে ‘অত্যন্ত অল্প খরচে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায়’ (ইউবিটি) সম্পর্কিত একটি বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা মাতৃমৃত্যুহার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
করেসপন্ডেন্ট, ৫ মার্চ ২০২০