ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। চারটি ক্ষেত্রে আবার বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে।
এই চারটি ক্ষেত্রের তিনটি হলো ছেলে ও মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা এবং সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন। চতুর্থ ক্ষেত্রটিতে অবশ্য মানুষের হাত নেই। সেটি হলো জন্মের সময় ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যাগত সমতা।
ডব্লিউইএফ গত সোমবার গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০১৮ প্রকাশ করে। এতে ১৪৯টি দেশের নারী-পুরুষের সমতার চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে মোট চারটি মূল সূচকের ওপরে দেশের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এগুলো হলো নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এর ভেতরে আবার ১৪টি উপসূচক আছে।
সার্বিক বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক যুগে নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে বেশ ভালো উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম। নারী-পুরুষ সমতায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশের পরে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, অবস্থান ১০০তম। নেপাল ১০৫, ভারত ১০৮, মালদ্বীপ ১১৩, ভুটান ১২২ ও পাকিস্তান ১৪৮তম অবস্থান পেয়েছে। র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নিকারাগুয়া। সবার শেষে ইয়েমেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এটা বাংলাদেশের একটি আশাবাদের দিক। অবশ্য তা এক দিনে হয়নি। দেশে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি একজন নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হয়ে নারীর শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করেছেন। অন্যজন সেটা আরও বাড়িয়েছেন। মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চালু হয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে বিরোধ দেখলেও নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঐকমত্য দেখেছি।’
রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, নারী শিক্ষার প্রভাব সবক্ষেত্রে পড়েছে। অর্থনীতি, শ্রমবাজার, রাজনীতি—সবকিছুর মূলেই রয়েছে নারীর শিক্ষা। অবশ্য সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়নে বেসরকারি সংস্থাগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে বাল্যবিবাহ কমানো, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও দক্ষতার দিক দিয়ে মান উন্নয়নের ওপর জোর দেন।
এক যুগের হিসাবে বেশ এগোলেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান অবশ্য গতবারের তুলনায় এক ধাপ অবনতি হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ৪৭তম হয়েছিল। চারটি মূল সূচকের মধ্যে এ বছর দুই দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। আগের বছর নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯তম, এবার তা ১৩৩। শিক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে পাঁচ ধাপ পিছিয়ে এবার অবস্থান হয়েছে ১১৬তম। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও আয়ুর ক্ষেত্রে ৮ ধাপ এগিয়ে ১১৭ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে দুই ধাপ এগিয়ে ৫ম হয়েছে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অগ্রগতি
বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সূচকে। এই সূচকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। অর্থাৎ পৃথিবীতে যেসব দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই সূচকে বাংলাদেশ প্রায় অর্ধেক বৈষম্য কমিয়ে এনেছে। যদিও পৃথিবীতে নারী-পুরুষ বৈষম্য সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে এই সূচকে। তালিকায় বাংলাদেশের ওপরে আছে কেবল চারটি দেশ; এক নম্বরে আছে আইসল্যান্ড, দুইয়ে নিকারাগুয়া, তিনে নরওয়ে ও চারে রুয়ান্ডা।
রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের তিনটি উপসূচক আছে। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম এবং নারী মন্ত্রীর সংখ্যার দিক থেকে ১২৬তম। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তাই নারী সরকারপ্রধানের দিক দিয়ে বিশ্বসেরা হয়েছে বাংলাদেশ।
শিক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। এ ক্ষেত্রেও কিছু উপসূচক আছে। এর মধ্যে সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থান পেলেও উচ্চশিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২১তম। এরপর স্বাস্থ্য ও আয়ুর সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭। এর উপসূচক আছে দুটি। ছেলে ও মেয়েশিশু জন্মের সমতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১ নম্বরে। আর আমৃত্যু সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। অর্থাৎ জীবনের শুরুতে নারীরা ভালো করলেও পরবর্তী জীবনে তা ধরে রাখা যাচ্ছে না।
আবার অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের দিক থেকে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। তাই দেখা যায়, এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। এ ক্ষেত্রেও কিছু উপসূচক আছে। এর মধ্যে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম, একই ধরনের কাজে মজুরি সমতার নিরিখে ১০৫, উপার্জনের নিরিখে ১১৪, ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ১৩৫তম। আর পেশাদার ও দক্ষ কর্মীর দিক দিয়ে ১৩০তম।
প্রতিবেশীদের অবস্থা
ভারত ২০০৬ সালের তুলনায় এখন আরও পিছিয়েছে। নারী-পুরুষ সমতার দিক দিয়ে ২০০৬ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ৯৮তম। এখন ১০ ধাপ পিছিয়ে ১০৮তম অবস্থানে ভারত। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ১৯তম, শিক্ষায় ১১৪, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে ১৪২ ও স্বাস্থ্যে ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে ভারত।
এক যুগে পাকিস্তান পিছিয়েছে ৩৬ ধাপ। সার্বিকভাবে ১৪৮তম হলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশটির অবস্থান ৯৭, শিক্ষায় ১৩৯, স্বাস্থ্যে ১৪৫ ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে ১৪৬তম।
বার্তা কক্ষ
২০ ডিসেম্বর, ২০১৮