জাতীয়

‘বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডার নিয়ে জটিলতা’

বছরের পঞ্চম মাস চলছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যে পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য গতকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের বই ছাপার একটি টেন্ডারেরও প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। অথচ এ বছরটি নির্বাচনের বছর হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের অন্তত আড়াই মাস আগে (৩০ সেপ্টেম্বর) সব বই স্কুলে বা উপজেলায় পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বিনামূল্যে পাঠ্যবই মুদ্রণ সমন্বয়কারী হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) তৎপরতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। চলতি বছরটি ‘নির্বাচনের বছর’- এই ধুয়া তুলে এখনই বই ছাপার কাগজের মূল্য টনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ‘বাজার নিয়ন্ত্রককারী একটি চক্র ও দেশীয় সিন্ডিকেট মিলে এ কাজটি করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

অভিযোগ রয়েছে এর সাথে যুক্ত হয়েছেন বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার সাথে জড়িত দেশীয় মুদ্রণকারীরা। তবে মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, প্রতি বছরই পাঠ্যবই ছাপার সময় কাগজের দাম বাড়ে। এবারো বাড়ছে এবং বাড়বে। বরং দেশীয় মুদ্রণকারীরা এই বর্ধিত মূল্যর শিকার। তিনি জানান, বিশ্বব্যাপী কাগজ তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে কাগজের বাজারে। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন এনসিটিবির বিরুদ্ধে। এনসিটিবি বাস্তবতা ও বাজার যাচাই না করে টেন্ডারে কাগজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। এ নিয়েই আসলে জটিলতার সূত্রপাত।

আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য সরকার প্রায় ৩৭ কোটি বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এনসিটিবি বই ছাপার জন্য যে দর দিতে চায়, তা নিয়ে অসন্তোষ মুদ্রণকারীদের। তারা বলছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম, নিরাপত্তা পেপারের দাম, অন্যান্য মুদ্রণ উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি গত বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এনসিটিবি যে দামে টেন্ডার কল করেছে, তাতে অংশ নিলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। মুদ্রাকরদের নেতারা বলছেন, এনসিটিবি নিজেই গত বছরের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দরে কাগজ কিনেছে। অথচ এনসিটিবি যখন টেন্ডার করছে তখন কম মূল্য নির্ধারণ করছে কাগজে। এ নিয়েই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যানের সাথে বোর্ড সদস্যের কথাকাটাকাটি : এনসিটিবির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক দিন থেকে এনসিটিবির বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার সাথে বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার নিয়ে বোর্ডের এক সদস্যের কথাকাটাকাটি হয়েছে। গতকাল দুপুরে বোর্ড চেয়ারম্যান ও ওই বোর্ড সদস্য চেয়ারম্যানের কক্ষে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক হয়েছে। চেয়ারম্যানের অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাইরে থেকে তালা দিয়ে তারা বৈঠক করেন।

এনসিটিবির জনৈক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চেয়ারম্যানের সাথে বোর্ড সদস্যের কথাকাটাকাটি নজিরবিহীন। এনসিটিবিতে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। এ ব্যাপারে গতকাল বিকেলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনাকে এ ধরনের কথা ও তথ্য কে দিয়েছেন? তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি, ঘটার প্রশ্নই আসে না।

এনসিটিবির অন্য একটি সূত্র গতকাল এ ব্যাপারে বলেন, পুরো বোর্ড এবং সব কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন একাট্টা হয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ শুরুর জন্য কাজ করার কথা, তখন বোর্ড চেয়ারম্যানের সাথে এক সদস্যের দ্বন্দ্ব-বিরোধ বইয়ের পুরো কাগজে বাধাগ্রস্ত করবে।

প্রাথমিকের বই ছাপার টেন্ডার নিয়ে জটিলতা : বিনা মূল্যে পাঠ্যবইয়ের জটিলতা তৈরি হয়েছে, প্রাথমিকের ১১ কোটি বইয়ের টেন্ডার নিয়ে। এ বই ছাপার জন্য গত ৫ মার্চ টেন্ডার আহ্বান করা হয়। গত ১২ এপ্রিল দরপত্র খোলা হয়েছে। ওই টেন্ডার ‘যাচাই-বাছাইয়ের জন্য’ এনসিটিবি গঠিত মূল্যায়ন কমিটি একাধিক দফায় বৈঠকে করেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। গত ৩ মে সর্বশেষ দফা বৈঠকে দ্বিধাবিভক্ত মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে (ডিপিইতে) পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। মূল্যায়ন কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে পুনঃটেন্ডারের অনুমতি চেয়ে ডিপিইতে পাঠানো হয়েছে। এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিকেলে এ-সংক্রান্ত নথি ডিপিইতে পাঠানোর তড়িঘড়ি চলছিল এনসিটিবিতে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল সন্ধ্যায় ওই নথি ডিপিইতে পাঠানোর কথা স্বীকার করেন।

প্রাক্কলনের চেয়ে টেন্ডার দাতারা কাগজের মূল্য বেশি দাবি করায় মূল্যায়ন কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন বলে জানা গেছে। এনসিটিবির ওই কমিটির একাংশ চাইছে, পিপিআরের নীতিমালার আলোকে বিদ্যমান টেন্ডার পুনঃমূল্যায়ন করতে। আরেক অংশ চাইছে, সম্পূর্ণ নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে। কিন্তু নতুন করে টেন্ডার ডাকা হলে সময় ও মুদ্রণের মান নিয়ে আরেক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হবে। এতে বর্তমান সময়ের চাইতে দুই মাস পিছিয়ে যাবে সব কিছুর। যার ফলে সময়মতো বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া যাবে না। নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করতে এনসিটিবির যে অংশ চাইছে, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছর এবং এ বছর ভিনদেশী কোনো প্রতিষ্ঠান বইয়ের টেন্ডারে অংশ নিয়েও কাজ পায়নি। তারা চাচ্ছেন, নতুন করে টেন্ডার হলে ভারতীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিকের বইয়ের কাগজের যে প্রাক্কলন তৈরি করা হয়, তাতে খোদ এনসিটিবির গোঁজামিল ছিল। এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কাগজের দর নির্ধারণ করেছে প্রতি মেট্রিক টন ৯৫ হাজার টাকা। আর প্রাথমিকের বইয়ের কাগজের প্রাক্কলন করেছে ৮২ হাজার টাকা।

উচ্চ মাধ্যমিকের বই জটিলতা : একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আগামী জুলাই মাসে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি বই নিয়ে। বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি। এ তিনটি বইয়ের টেন্ডারে কোনো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি। ৯৩টি টেন্ডার শিডিউল বিক্রয় হলেও গত ৩ মে টেন্ডার বাক্স খোলার দিন দেখা গেল প্রায় ৩০ লাখ বই ছাপার জন্য এনসিটিবিতে কেউ টেন্ডার জমা দেয়নি। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে আরেক জটিলতা। টেন্ডার প্রাক্কলনে বাংলা ও বাংলা সহজ পাঠের দাম বাড়ানো হলেও ইংরেজি বইয়ের দাম গত বছরের দামেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। দেশীয় মুদ্রণকারীরা এ ক্ষেত্রেও একই দাবি করে বলছেন, কাগজসহ মুদ্রণ উপকরণের দাম বিগত বছরের চেয়ে বেড়েছে।

এনসিটিবি এ বিষয়কে এড়িয়ে টেন্ডার ডেকেছে। তাই কেউ টেন্ডারে অংশ নেয়নি। তাই উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুদ্রণকারীরা বলছেন, বাংলা বইয়ে এ বছর নতুন দু’টি গল্পযুক্ত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া ওই তিনটি বইয়ের বড় কোনো পরিবর্তন নেই। ফলে এত বিপুল পরিমাণ বইয়ের বাজার চাহিদাও নেই। ফলে বই বিক্রি না হলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে মুদ্রণকারীদের। উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি বই বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি শিক্ষার্থীদের মূল্য পরিশোধে কিনতে হয়। এবার বাংলা বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ১২১ টাকা। বাংলা সহজ পাঠের দাম ধরা হয়েছে ৫৯ টাকা ও ইংরেজি বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ৮১ টাকা।

টেন্ডারে অংশ নিলেও কাগজের দাম নিয়ে অসন্তোষ : গতকাল মাধ্যমিকের প্রায় ১৭ কোটি বই ছাপার জন্য টেন্ডার খোলা ও ফেলার ছিল শেষ দিন। এতে দেশীয় মুদ্রণকারীরা শেষ মুহূর্তের টেন্ডারে অংশ নিলেও টেন্ডারে কাগজের মূল্যের যে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে, তাতে আপত্তি দেশীয় মুদ্রণকারী নেতাদের। তাদের দাবি মুদ্রণ উপকরণসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, প্রাক্কলনে তার প্রতিফলন না থাকলে টেন্ডার জমা দিলেও কাজ করবে কি না তা পরে বিবেচনা করা হবে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি থেকে মৌখিক আশ্বাসে তারা টেন্ডারে অংশ নিয়েছেন।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান গতকাল বলেন, শুধু কাগজ বা কাগজ তৈরির মণ্ডই নয়; মুদ্রণের পেট, কালি, গামসহ সব সামগ্রীর দ্রব্যাদির দাম বেড়েছে। এ কারণে দরদাতারা বেশি দামে বইয়ের কাজ নিতে চান। কিন্তু এনসিটিবি অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের কাগজ যে দরে তারা কিনছে, তার চেয়ে ভালো মানের কাগজের দাম ২৩ থেকে ২৯ হাজার টাকা কম প্রাক্কলন করেছে টেন্ডারে। আমরা বইয়ের কাজ করতে চাই। কিন্তু লোকসান দেয়ার জন্য কেউ কাজ নেবে না।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সহসভাপতি শ্যামল পাল বলেন, কাগজসহ মুদ্রণ উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি গত বছরের চেয়ে ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এনসিটিবি নামেমাত্র হারে বইয়ের দাম বাড়িয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের নকল বই বাজারে বিক্রি হয়। বাজারে এনসিটিবির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

Share