বিদ্যুৎ সঙ্কটে জনদুর্ভোগ চরমে

দেশব্যাপি বিদ্যুৎ সঙ্কট বেড়েছে। রাতে দিনে দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। কার্তিক মাসে অসহনীয় গা-জ্বালা গরমের সাথে বিদ্যুতের ঘনঘন আসা-যাওয়া খেলায় অতিষ্ঠ শহর এবং গ্রামের বাসিন্দারা। বিদ্যুতের অভাবে থমকে গেছে উৎপাদনের চাকা। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এবং বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রামের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। রাতে দিনে দফায় দফায় লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রামের পরিস্থিতি আরও নাজুক। সেখানে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ মিলছে না।

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তাতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়নি। উন্নয়নের নামে লুটপাট আর বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা দিতেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জ্বালানি নির্ভর সরকারি-বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন এক একটা সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে বর্তমান বিদ্যুৎ সঙ্কটের অন্যতম কারণ ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎখাতে একক আধিপত্য। এই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। মাতারবাড়ি, বাঁশখালী পায়রা, ও রামপালে কয়লা প্রদানে চড়া দাম চাওয়া, বকেয়া বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে চাপও প্রদান এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অর্ধেকের নিচে নামিয়েছে তারা। যে কারনে দেশব্যাপি বিদ্যুৎ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হাসিনার আমলে করা ‘একতরফা’ চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে আদানি। হাসিনার সময়ে গত জুলাই থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার বাড়তি দাম ধরে বিদ্যুৎ বিল করছে আদানি। বকেয়া বিল পরিশোধে বাংলাদেশকে চাপও দিচ্ছে। অথচ গত বছরই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগেই কয়লার দাম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর দাম কমাতে রাজি হয় আদানি।

পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে কম দামে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেয় তারা। তবে এক বছর পর এখন আবার ২২ শতাংশ বাড়তি দাম চাইছে আদানি। এদিকে হাসিনার ভারতে পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বড় দায়িত্ব পেলেও অভিযোগ আছে উপদেষ্টার অফিস না করে একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখায় ব্যস্ত থাকেন তিনি। তাই বিদ্যুৎ সঙ্কট দূরীকরণে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এই সঙ্কট আগামী দিনে বাড়বে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

পিডিবি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানির নামে ঋণপত্র (এলসি) খোলার কথা ছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে। এই ঋণপত্র খোলার কথা ছিল কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে; কিন্তু সেটা হয়নি। পিডিবি আরও সময় চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে একটি ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে আদানি। ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার চালু ইউনিট থেকেও উৎপাদন হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াটের একটু বেশি। একই সময়ে কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। বকেয়া জটিলতায় উৎপাদন কমেছে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে গত বৃহষ্পতিবার ঘণ্টায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে।

পিডিবি সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। আর আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। তার মানে প্রতি টন কয়লায় পায়রা ও রামপালের চেয়ে ২১-১৬ ডলার বাড়তি চাইছে তারা।

কয়লাভিত্তিক আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনবে বাংলাদেশ। প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। দ্বিতীয় ইউনিটে শুরু হয় একই বছরের জুনে। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করে কয়লার দামের বিষয়টি সুরাহা করেছিল আদানির প্রতিনিধিদল। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের জন্য কয়লার প্রকৃত দামে বিল করেছে তারা। গত জুলাই থেকে চুক্তি অনুসারে কয়লার বিল করছে আদানি।

চট্টগ্রাম থেকে রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু গ্যাস, কয়লা আর ফার্নেস অয়েলের অভাবে বেশিরভাগ কেন্দ্র বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। এ অঞ্চলের ২৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট। বর্তমানে সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে আরো অন্তত ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কয়লার অভাবে ১১শ’ ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। একই কারণে বাঁশখালীর গন্ডামারায় এস আলমের যৌথ মালিকানাধীন ১২শ’ ২৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে।

এর ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৪শ’ মেগাওয়াটের নিচে নেমে এসেছে। জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ দেয়ার পর চট্টগ্রামের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ মিলছে না। এর ফলে গড়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। পিডিবির হিসেবে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে পিকআওয়ারে উৎপাদন হয়েছে এক হাজার ৬৬২ মেগাওয়াট। দিনের বেলা এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৭৫ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কল-কারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এমনিতেই গ্যাস সঙ্কটের কারণে শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে। তার উপর বিদ্যুৎ সঙ্কট মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার ব্যুরো জানায় : শীত মৌসুম শুরু হলেও এখনো কমেনি গরম। তার উপর কক্সবাজারে অসহনীয় লোডশেডিং এ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। সম্প্রতি আদানি, বাঁশখালী ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যায়। এতে লোডশেডিং বেড়েছে বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার পিডিবি সূত্রে জানাগেছে, কক্সবাজার শহর রামুর একাংশ চকরিয়ার একাংশ, লামা ও কুতুবদিয়া উপজেলায় পিডিবির বিদ্যুৎ গ্রাহক আছে ৬৫ হাজার। এই এলাকায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায় ৪৫ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন বিদ্যুৎ কম পাওয়া লোডশেডিং হয় নিয়মিত। সম্প্রতি এটি বেড়েছে আরো।

অপরদিকে কক্সবাজার শহর উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়ার একাংশ, রামুর একাংশ ও মহেশখালী উপজেলা পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন। এখানে গ্রাহক আছে প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজারের মতো। এখানে ১৫৫ মেগাওয়াটের মত বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও সূত্রমতে তারা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন ৬০-৭০ মেগাওয়াট। তাই গ্রামাঞ্চলে মাত্রা অতিরিক্তভাবে বেড়েছে লোডশেডিং।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক সভাপতি ও উখিয়া এবি পার্টির আহবায়ক সৈয়দ হোসেন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। যারা সরবরাহ করেন বা বিদ্যুৎ বিতরণ করেন তারা নিরুপায় হয়ে লোডশেডিং করে থাকেন।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, বগুড়ায় বিদ্যুৎ সঙ্কটজনীত কারণে দুর্ভোগে নাকাল হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একই সাথে কৃষি ও শিল্পখাতে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন। বিদ্যুৎ বিভাগ যদিও বলছে, চাহিদার ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ মিলছে। সামনে সরবরাহ আরো বাড়বে। তখন সঙ্কট পুরোপুরি কেটে যাবে।

এদিকে দুর্ভোগের শিকার সাধারণ মানুষ বলছে, ভেবেছিলাম নতুন সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আগের মত ঘনঘন লোডশেডিং হবেনা। বাস্তবে সেই প্রত্যাশা আর পূরণ হলো কৈ।
ক্ষুব্ধ গৃহবধূরা জানান, ঘনঘন যাওয়া আসার কারণে বাড়ির ফ্রীজ, টেলিভিশন, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই খাতে যোগ হচ্ছে বাড়তি খরচ।

বিদ্যুৎ সঙ্কটে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায়ও ঘটছে ব্যাঘাত। সবচেয়ে সঙ্কটে পড়েছে শিল্পখাত। বগুড়াকে বলা হয়, শিল্প নগরী। এখানে ফাউন্ড্রী, কোল্ড স্টোরেজ, অটোরাইস মিল, চাতালসহ বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। কিন্তু বিদ্যুৎ সঙ্কটে বহু শিল্পকারখানা বন্ধ ও লে অফ হয়ে আছে। দ্রুত বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভেঙে পড়বে শিল্প খাত।

অন্যদিকে কৃষি খাতে সেচ পাম্পগুলো প্রায় সময় অচল থাকছে। তবে বগুড়া নেসকোর ১,২,৩ ও ৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলীরা জানান, বগুড়ায় এখন বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ১০৫ মেগাওয়াট। তবে মিলছে চাহিদার ৭০ শতাংশ। সামনে সরবরাহ আরো বাড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশাল নগর মহানগর থেকে সুদূর পল্লী এলাকার প্রায় ৩০ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহকের দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। সন্ধ্যপীক আওয়ারে প্রায় ৯শ’ মেগাওয়াট চাহিদার দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে সরবারহ ৫শ’ মেগাওয়াটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ভারতীয় আদানী এবং পায়রা, রামপাল মাতারবাড়ীসহ কয়লা ভিত্তিক বেশ কয়েকটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হ্রাসের ফলে জাতীয় গ্রীডে সরবারহ সঙ্কটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের ৬ জেলার ৪২টি উপজেলায় সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ ঘাটতি মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বছর শেষের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে এ বিদ্যুৎ ঘাটতি দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ১১ লাখ স্কুল-মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।

শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্যের অবস্থা ক্রমে নাজুক হচ্ছে। বেশীরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানেই প্রতি শিফটে ২-৩ ঘণ্টা পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। ফলে লোকশান ঝুকির মুখে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানই বিকল্প পথ খুজছে।

ব্যবসা-বানিজ্যের অবস্থাও করুন। বিশেষকরে সন্ধ্যার পরে লোডসেডিং-এ গ্রাহকশূন্য হয়ে পড়ায় ব্যবসার খড়ায় ধুকছে বেশীরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে ঝুকির চেয়েও চরম অনিশ্চয়তা তৈরি করছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে বার্ষিক চূড়ান্ত পরিক্ষার আগের এ বিদ্যুৎ ঘাটতি দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ১১ লাখ ছাত্র-ছাত্রীকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বরিশাল মহানগরীসহ এ অঞ্চলের শহরগুলোতেও সন্ধ্যা থেকে নূন্যতম দু’দফায় ১ ঘণ্টা করে লোড সেডিং পল্লী এলাকায় আরো দীর্ঘায়িত হচ্চে। ফলে গ্রামে-গঞ্জের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।

দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পনী ‘ওজোপাডিকো’র প্রায় ৪ লাখ গ্রাহক ছাড়াও ৬টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আরো ২৪ লাখ গ্রাহকের মাধ্যমেই এঅঞ্চলের পায় কোটি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত হলেও এখন প্রতিদিন ৪-৬ ঘণ্টারও বেশি অন্ধকারে থাকছে সবাই। কবে এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটবে তা বলতে পারছেন না বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল মহল। তবে বরিশাল অঞ্চলে সরকারী-আধা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদিত প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সরবারহ করা হলেও সেখানে থেকে এ অঞ্চলের চাহিদা মাফিক ডে-পীক আওয়ারে ৬শ’ মেগাওয়াট এবং ফুল-পীক আওয়ারে ৯শ’ মেগাওয়াটের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ মিলছে না।

অপরদিকে, ভঙ্গুর বিতরণ ব্যবস্থার কারণেও বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্রই গ্রাহকে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছান নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। এ অঞ্চলে ওজোপাডিকো এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো গ্রাহক সেবার বিষয়টি সুষ্ঠু বিবেচনায় নিয়ে বিতরণ ও সরবারহ ব্যবস্থা উন্নত করতে পারেনি। এখনো সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষন ও মেরামত ব্যবস্থাসহ নিবিড় গ্রাহক সেবা গড়ে তুলতে পারেনি বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি পিডিবি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লাইনসহ বিদ্যুৎ স্থাপনা নিয়ে গঠিত হবার প্রায় দুই দশক পরেও ওজোপাডিকো সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলেও অভিযোগ গ্রাহকদের। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো সুদূর পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে অতিরিক্ত টেকসইসহ ভিন্ন নকশায় লাইন ও সাব-স্টেশনসমূহ গড়ে তুললেও দীর্ঘ দিনেও তারা সঠিক পেশাদারিত্বে পরিচয় দিতে পারেনি বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।

এসব বিষয়ে ওজোপাডিকো এবং বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দায়িত্বশীল মহলের দাবি ‘বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি তাদের হাতে নেই, তবে সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে সম্ভব সব প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’

যশোর ব্যুরো জানায়, যশোরে বয়ে চলেছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। এরমধ্যে রাতে ও দিনে তীব্র লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি জনজীবনে বাড়তি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, শহরাঞ্চলে লোডশেডিং মোটামুটি সহনীয় হলেও গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। এ অবস্থায় চরম ভোগান্তি পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা চরম কষ্টে দিন পার করছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
যশোর সদর বেজপাড়া এলেকার গৃহবধূ শাবানা বেগম বলেন, বিদ্যুতের ভোগান্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। এক ঘণ্টা থাকছে তো আরেক ঘণ্টা থাকছে না। বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। ডাকাতিয়া গ্রামের সুমন হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ সারাদিন আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছে। তবে বাড়ির পাশে নদী থাকায় বাতাসের কারণে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

ঝিকরগাছা কাটাখাল এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, রাত-দিন মিলে অন্তত ছয় থেকে আটবার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার এক ঘণ্টা পর আসছে। ঝিকরগাছা রঘুনাথনগর মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল আব্দুল ওহাব বলেন, আমাদের এখানে বিদ্যুৎ মোটেও থাকছে না। বিদ্যুৎ না থাকায় শিক্ষার্থীরা খুব কষ্ট পাচ্ছে। বিদ্যুতের এ অবস্থা থাকলে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তিনি।

শার্শা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শামীমা সুলতানা সালমা জানান, বেনাপোল এলাকায় নিয়মিত দিনে পাঁচ থেকে সাতবার বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে। এর চেয়ে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে গ্রামগঞ্জে। নাভারণ বিদ্যুৎ অফিস আওতাধীন করিমালী গ্রামের গ্রাহক ও নাভারণ বাজারের বীজ ব্যবসায়ী মশিয়ার রহমান জানান, রাতে বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার সঠিক কোনো হিসাব নেই। আধা থেকে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ স্থায়ী থাকে। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মিনারুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিং এ সাধারণ জীবনযাপন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো বসতে পারছি না।

নাভারণ বিদ্যুৎ অফিসে দায়িত্বরত শিবলু মুন্সি জানান, দেশের কোনো এক এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পাওয়ার গ্রিড বন্ধ হওয়াতে লোডশেডিংয়ের এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে। তবে অচিরেই এ সমস্যা সমাধান হবে বলে জানান।

যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার ইছাহাক আলী জানান, গ্রাহকদের চাহিদা ১৫০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট। সরবরাহ কম পাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। হয়তো দু’একদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন তিনি।

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, আবহাওয়া কিছুটা সহনীয় হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমলেও এখনো সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। নগরীতে নেসকো আর গ্রামে পল্লী বিদ্যুত সমিতি সরবরাহ করে। নগরীতে প্রতিদিন নেসকোর চাহিদা দেড়শো মেগাওয়াট হলেও সরবরাহ একশো ত্রিশ মেগাওয়াট। এনিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখা হচ্ছে। আলোকজ্জল নগরীর রাজশাহীর সড়কবাতি গুলো পালাক্রমে বন্ধ রাখা হচ্ছে। এখানে তেমন কল কারখানা না থাকায় এর প্রভাব কম। তবে সেচ নির্ভর বরেন্দ্র অঞ্চলে এখনো মাটির নীচ থেকে পানি তুলে এখনো। বরেন্দ্র অঞ্চলের কোথাও কোথাও গভীর নলকুপের পানি তুলে সেচ দেয়া হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। (ইনকিলাব)

Share