নিউজ ডেস্ক:
দেশ-বিদেশের সন্তানহীন দম্পতিদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ভারতে গর্ভ ভাড়া দেয়ার ব্যবসা ক্রমশ বাড়ছে। ভারতে এটি সহজলভ্য ও খরচ কম হওয়ায় গর্ভ ভাড়া বা সারোগেসি বাণিজ্যের বাজার দাঁড়িয়েছে ১৫০০ কোটি টাকার মতো।
তবে এ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। একপক্ষ বলছে, গর্ভ ভাড়া নৈতিকতাবিবর্জিত। অন্যপক্ষ বলছে, এ ব্যাপারে নৈতিকতা বা অনৈতিকতার প্রশ্ন আসতে পারে না। কারণ, এর মাধ্যমে সন্তানহীন দম্পতি পাবেন সন্তান, তারা মুক্ত হবেন দুশ্চিন্তা থেকে। এতে দোষের কিছু নেই।
এমন বিতর্কের মধ্যে নৈতিকতা ও অনৈতিকতার সীমারেখা নিয়ে যুক্তি টেনে বলা হচ্ছে, দেহদান বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন যদি অনৈতিক না হয়, তাহলে গর্ভ ভাড়া অনৈতিক হবে কেন? একজন সন্তানহীন দম্পতি, যারা নানাভাবে চেষ্টা করেও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি, তারা সন্তান পাবেন – এর মধ্যে অনৈতিকতা কোথায়?
অন্যদিকে, বিরুদ্ধবাদীরা বলছেন, দেহদান বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন এককালীন চিকিত্সা প্রক্রিয়া। নব্য ধণতান্ত্রিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের এক ইতিবাচক দিক। কিন্তু গর্ভ ভাড়া নিয়ে গর্ভধারণের চিকিত্সা প্রক্রিয়া হয় দীর্ঘকালীন। আইভিএফ পদ্ধতিতে স্ত্রী ও পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু দেহের বাইরে নিষিক্ত করে তা নারীর গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। বলা বাহুল্য, সন্তান জন্ম না হওয়া পর্যন্ত যে নারী গর্ভধারণ করেছেন, তার দেখভাল, চিকিৎসা সবকিছুই করতে হয়।
নৈতিকতার অবশ্য আরও একটা দিক আছে। যে গরিব নারীর গর্ভ ভাড়া নেয়া হচ্ছে, তার প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব কে নেবে? এখানেও রয়ে গেছে একটা ধোঁয়াশা। এত ঝুঁকি নেয়ার বিনিময়ে যে অর্থ প্রসূতিকে দেয়া হয়, তা বড়জোর তিন-চার লাখ টাকা৷ এ অর্থের একটা বড় অংশই কমিশন হিসেবে চলে যায় এজেন্টের পকেটে।
ভারতে গর্ভ ভাড়া দেয়ার ব্যবসার পরিসর দ্রুত বাড়ছে, যেহেতু এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত আইন এখনও নেই দেশটিতে। কৃত্রিম উপায়ে গর্ভাধান নিয়ন্ত্রণ বা অ্যাসিস্টেট রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি বিল এখনও পাস হয়নি। ৩৮ বছর আগে ভারতে কৃত্রিম গর্ভাধান বা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) যাত্রা শুরু হয়। আর এখন ভারতে প্রায় ২০ হাজার আইভিএফ ক্লিনিক আছে, যার বেশিরভাগই অবশ্য অনুমোদিত নয়। এ ধরনের ক্লিনিক সবচেয়ে বেশি আছে দিল্লি, মুম্বই ও চন্ডিগড়ে।
এদিকে, ভারতে সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা প্রায় ১৫ থেকে ১৬ কোটি। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে গরিব ও অশিক্ষিত পরিবারের নারীদের গর্ভ ভাড়া দিতে এজেন্টরা রাজি করায় এবং সেই সুযোগটা নিয়ে থাকে বিদেশি সন্তানহীন দম্পতিরা। উন্নত দেশগুলিতে গর্ভ ভাড়া দেয়ার নিয়মবিধি খুব কড়া। আর দিলেও পয়সা দেয়া-নেয়া নিষিদ্ধ। তবে, গর্ভ ভাড়া নেয়ার আগে ওই নারীর বয়স ৪৩ বছরের নীচে কিনা, সেটা দেখে নেয়া হয়। দেখে নেয়া হয় তার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য।
এছাড়া, আগে তিনি অন্তত একটি সন্তানের মা হয়েছেন কিনা এবং গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মের সময় কোনো সমস্যা হয়েছিল কিনা–সেটাও যাচাই করা হয়।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এর মধ্যে আইভিএফ ক্লিনিকের ডাক্তারদেরও কিছু কারসাজি আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীকে জানতে দেয়া হয় না কতগুলি ভ্রুণ তার গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। চিকিত্সা শাস্ত্র অনুযায়ী দুটি বা তিনটির বেশি ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করা হলে, তা একেবারেই নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে মায়ের স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ঝুঁকি থেকে যায়। এ বিষয়ে গরিব অশিক্ষিত মায়ের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না বা তাদের মতামত চাওয়া হয় না। তাদের অন্ধকারে রেখেই নারীর ভাড়া করা গর্ভে অনেকগুলি ভ্রণ প্রতিস্থাপন করা হয়।
চিকিত্সা শাস্ত্রের দৃষ্টিতে এটা অনৈতিক, বলেন সমাজবিদ তুলিকা প্যাটেল। যিনি এ বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন। ভারতীয় চিকিত্সা গবেষণা পরিষদের (আইসিএমআর) নির্দেশিকায় বলা আছে, একইসঙ্গে দু’জন নারীর গর্ভ ভাড়া নেয়া যাবে না। অথচ সেটা যাচাই করার কোনো ব্যবস্থাপনা নেই ভারতে। ইচ্ছুক দম্পতি পরে চাইলে একটি রেখে অন্যটির গর্ভপাত করিয়ে নেন।
গবেষকদের মতে, যেহেতু নারী একাধিকবার গর্ভবতী হতে পারেন, সেহেতু বারংবার তার গর্ভ ভাড়া নেয়ার বা দেয়ার একটা তাগিদ থাকে। দিল্লির একটি নাম করা হাসপাতালের আইভিএফ সেন্টারের প্রধান ডাক্তার আভা মজুমদার বলেন, ‘এমন অনৈতিকতা বেশি হয় গর্ভ ভাড়া নিতে ইচ্ছুক বিদেশি দম্পতিদের ক্ষেত্রে। কমিশন এজেন্টরা বেশি পয়সার লোভে সব ব্যবস্থা করে দেয়। তাই এই প্রবণতা রোধে দরকার কড়া আইন।’
সারোগেসি পদ্ধতিতে ভূমিষ্ট হওয়া সন্তানের কিছু আইনগত অন্য দিকও আছে। প্রচলিত বা ট্র্যাডিশনাল আইভিএফ পদ্ধতিতে নারীর ডিম্বাণু এবং গর্ভ– দুটোই ভাড়া নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে সন্তানের ওপর মায়ের একটা জৈবিক অধিকার থেকে যায়। অন্যটা হলো জেস্টাশন আইভিএফ। এক্ষেত্রে মায়ের ডিম্বাণু ‘স্পার্ম ব্যাংক’ থেকে আনা অন্য পুরুষের শুক্রাণুর সঙ্গে অথবা পিতার শুক্রাণু ডোনার নারীর ডিম্বাণু দেহের বাইরে নিষিক্ত করে ভাড়া দেয়া নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। যেহেতু গর্ভ ভাড়া দেয়া নারীর ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়নি, সেহেতু ভূমিষ্ট সন্তানের ওপর সেই নারীর কোনো অধিকার বর্তায় না। তবে মাতা-পিতার ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু নিষিক্ত করে যে ভ্রুণ তৈরি করা হয়, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না।
অনেকে আবার আইভিএফ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করাকে টেস্ট-টিউব বেবি বলে ভুল করে থাকেন। প্রতিটি টেস্ট-টিউব বেবি ভ্রুণ অবস্থায় মাতৃগর্ভেই বেড়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, জিনগত দিক থেকে কোনো ত্রুটি থাকলে তা প্রতিস্থাপন করা হয় না। (ডিডব্লিউ)