মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদে চলছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। আর সীমান্তে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে নেমেছে সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)।
বুধবার দিবাগত রাতে নাফ নদে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুবাহী নৌকায় নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে তারা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ও ভয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে কমপক্ষে ৪৩ জন। নৌকা থেকে লাফ দেওয়ার পর কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক রোহিঙ্গা যুবক কাছে এমন মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সীমান্তের ওপার থেকেও এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
নাফ নদের ওপারের বাসিন্দা ও এপারে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডুতে সে দেশের সেনাবাহিনীর তাণ্ডব থেকে বাঁচতে হাজারো রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ নাফ নদের ওপারে অবস্থান করছে। নদের উভয় তীরে থাকা দুই দেশের দালালরা অর্থের বিনিময়ে তাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে। আর এপারে বিজিবির পাহারা নেই এমন স্থান দিয়ে অনুপ্রবেশ করিয়ে দালালচক্র অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
ওপারের প্রাংপ্রো এলাকার বাসিন্দা এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না) মোবাইল ফোনে জানান, বুধবার রাতে নাফ নদের মিয়ানমার অংশ থেকে একটি বড় নৌকা বোঝাই হয়ে লোকজন নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য রওনা হয়। নৌকাটি লক্ষ্য করে বিজিপি সদস্যরা উপর্যুপরি গুলি চালাতে থাকে। নদের ধারে বাড়ি হওয়ায় তিনি স্পষ্টই গুলির শব্দ শুনতে পান।
আর শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) তিনি নদের ওই অংশে সারি সারি লাশ ভাসতে দেখেন। তিনি ও স্থানীয় অন্য অনেকে গণনা করে ভাসমান অবস্থায় কমপক্ষে ৪৩টি লাশ পেয়েছেন। ওই নারী আরো জানান, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিজিপি ৬৬ জনকে আটক করে মংডু শহরে নিয়ে গেছে বলে তিনি শুনতে পেয়েছেন।
বিজিপি যে নৌকাটিতে গুলি চালিয়েছে সেটিতেই ছিলেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী ইমান হোসেন। তিনি মংডুর ওয়াবেক এলাকার মৃত কালু মিয়ার ছেলে।
তিনি বলেন, বুধবার রাত ৮টায় নাফ নদের মিয়ানমার প্রান্ত থেকে একটি নৌকাযোগে অনেক শিশু, নারী ও পুরুষ বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। দুই ছেলে সলিম উল্লাহ (১৮) ও সালামত খানকে (১৪) নিয়ে তিনিও ওই নৌকায় ছিলেন। নৌকাটি সামনের দিকে আধকিলোমিটার এগোনোর পর হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। গুলি ছুড়তে ছুড়তে নৌকাটির দিকে স্পিডবোট ছুটে আসতে থাকে। এ সময় নৌকার আরোহীদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। তিনি অন্ধকারের মধ্যেই দেখেন, গুলিবর্ষণকারীরা বিজিপির সদস্য।
উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের মুখে তাঁদের বহনকারী নৌকাটি আংশিক ডুবে গিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এ সময় অনেকেই নাফ নদে লাফিয়ে পড়ে। আবার শিশুসহ কেউ কেউ নৌকায়ই রয়ে যায়। তিনিও নদে লাফ দেন। ওদিকে বিজিপি সদস্যরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে নৌকাটি তাদের সপডবোটের সঙ্গে বেঁধে মিয়ানমারের দিকে নিয়ে যায়।
নৌকাটি বিজিপি নিয়ে গেলেও যারা নদে লাফ দিয়েছিল তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা ইমাম হোসেন জানেন না। তবে তাঁকে উদ্ধার করেছে নাফ নদে মাছ ধরার একটি নৌকা।
ওই নৌকার মাঝি রশিদ আহমদ তাঁকে টেকনাফের কেরুনতলী এলাকার একটি বাড়িতে পৌঁছে দেন। ওই বাড়িতেই বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া ইমাম হোসেনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁর দুই ছেলে সলিম উল্লাহ ও সালামত উল্লাহর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না।
বিজিপির গুলিতে ৪৩ জনের মৃত্যু এবং ৬৬ জনকে আটকের বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মৃতদের মধ্যে কতজন গুলিবিদ্ধ আর কতজন পানিতে ডুবে মারা গেছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যও পাওয়া যায়নি।
নাফ নদে শুলির শব্দের বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্ট গার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. আতাউর রহমান বলেন, ‘বুধবার রাতে লোকজনের কাছে নাফ নদে চিত্কার হচ্ছে শুনে একটি টিম পাঠানো হয়। কিন্তু কোস্ট গার্ড টিম গিয়ে কোনো রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা পায়নি। রোহিঙ্গারা অন্য স্থানে সরে গেছে বা তাদের বিজিপি নিয়ে গেছে। ’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজে গুলির শব্দ শুনিনি, তবে স্থানীয়রা শুনেছে বলে জানিয়েছে। ’
অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় হাজারো রোহিঙ্গা :
ওপার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য মতে, হাজার হাজার মানুষ সীমান্তে এসে ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে অবস্থান করছে। অর্থের বিনিময়ে দালালদের মাধ্যমে এপারে পাড়ি জমাতে অপেক্ষা করছে তারা। আর দুই পারের দালালরা মূলত বিজিবি-বিজিপির টহল এড়িয়ে কৌশলে রোহিঙ্গাদের নৌকায় তুলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে। দুই পারের দালালদের অর্থ দিয়েই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে অনুপ্রবেশকারী একাধিক রোহিঙ্গা পরিবার।
ওপারে অবস্থানরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য নাফ নদের তীরে হাজারো মানুষ অপেক্ষা করছে। তারা নৌকা পেলেই সুযোগ বুঝে উঠে পড়ছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশের দালালরা অর্থের বিনিময়ে তাদের নাফ নদ পার করে দিচ্ছে।
মংডুর এক বাসিন্দা ফোনালাপে জানান, তাঁর ১০ বছরের মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ওই মেয়ের সঙ্গে আরো দুজন গুলিবিদ্ধ রোগীকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসার জন্য গত মঙ্গলবার থেকে চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর গুলিবিদ্ধ আহতরা সেখানে চিকিত্সা পাচ্ছে না।
এদিকে সীমান্তে তিন দিন ধরে অবস্থান করেও ওপার থেকে এপারে আসতে পারেননি। গুলিবিদ্ধ আহতরা চলাফেরায় অক্ষম হওয়ায় সংকট আরো তীব্র হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে আনার পর কোনো হাসপাতালে চিকিত্সা দেওয়া আসলেই সম্ভব হবে কি না, নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যাবে—এমন শঙ্কাও আছে। (কালেরকণ্ঠ)
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:৩০ এএম, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬, শনিবার
ডিএইচ