বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির বিগত তিন মাসের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর ও সহায়তা করেনি বিএনপি। এমন অভিযোগ উঠেছে দলটির ভেতর থেকেই।
শত শত মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মী জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখ থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। অনেকে হয়েছেন গুম ও হত্যার শিকার। যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে কারাগারে আছেন, তাদের প্রতিও ন্যূনতম দায়িত্ব পালন করেনি বিএনপি বা এর অঙ্গ সংগঠনগুলো।
দলীয় সূত্র বলছে, মামলার ঘানি টানতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের নাভিশ্বাস উঠছে এখন। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিঃস্ব প্রায়। আবার মামলার আসামি হলে দল থেকে কর্মীরা কোনো ধরনের আর্থিক বা আইনী সহায়তা পায় না বললেই চলে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ছে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও।
জানা যায়, বিগত তিন মাসের অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি চলার সময়ে রাজধানী ঢাকাতে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের দেড়শতাধিক নেতাকর্মী আটক হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও সংগঠন থেকে এসব নেতাকর্মীকে সহায়তা দেওয়া হয়নি বলে কাছে স্বীকার করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের দফতর সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু।
তিনি বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন বেশিরভাগ সিনিয়র নেতাই ছিলেন আত্মগোপনে। তাদের সঙ্গে সংগঠন ছিল সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নেতাকর্মীদের সংগঠন থেকে তেমন সহযোগিতা করা যায়নি। তবে অনেক নেতা ব্যক্তিগতভাবে যখন পেরেছেন কর্মীদের সহায়তা করেছেন।’
বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। এসব নেতাকর্মীর খোঁজ-খবর সংগঠন থেকে নেওয়া হয় না বলে ভুক্তভোগীদের কাছে শোনা যায়।
ছাত্রদল দফতরের দেখভাল করা সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান জানান, বিগত তিন মাসের আন্দোলনে শুধু ঢাকায় তাদের সংগঠনের প্রায় দু’শ’র মতো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব-পুলিশ। গত কয়েকদিনে অনেকে জামিন পেয়ে বের হয়ে গেছেন। এখনও ছাত্রদলের শতাধিক নেতাকর্মী জেলে বন্দী আছেন। বেশিরভাগই কাশিমপুর ও কিছু ঢাকা জেলে রয়েছেন।
তিনি জানান, ছাত্রদল থেকে এসব বন্দী নেতাকর্মীদের কিছু অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে এ সহযোগিতা উল্লেখ করার মতো নয়। যথেষ্ট অর্থ সহায়তা না দিতে পারলেও সংগঠন থেকে চেষ্টা করা হয়েছে তাদের আইনী সহায়তা দেওয়ার। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দিয়ে দলীয় আইনজীবীদের বলে দেওয়া হয়েছে। তারা আটকদের আইনী সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নাজমুল আরও জানান, সারাদেশে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার ছাত্রদল নেতাকর্মী বন্দী। সংশ্লিষ্ট জেলা বিএনপি নেতারা যেন এসব কারাবন্দী নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেন, সে ব্যাপারে সংগঠন থেকে বলে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব নেতাকর্মীরা দল থেকে কতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা পান বা পেয়েছেন তা তদারকি করা হয় না।
তিনি জানান, গত তিন মাসের আন্দোলনে সারাদেশে ছাত্রদলের মোট ১৬ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। নিখোঁজ ছিলেন কয়েক শতাধিক। তবে দীর্ঘদিন নিখোঁজ রাখার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টাকা-পয়সা দিয়ে অনেকে মুক্ত হতে পেরেছেন। এসব টাকাও নিজ নিজ পরিবার থেকেই জোগান দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, তেজগাঁও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ও তিতুমীর কলেজের আরও দুই ছাত্রদল নেতাকর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। জানি না তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে।
দল বলছে ভিন্ন কথা
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, আটক ও মামলার শিকার হওয়া নেতাকর্মীদের বিনা খরচায় আইনী সহায়তা দেওয়ার জন্য দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার নির্দেশে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি নেতাকর্মীদের আইনী সহায়তার বিষয়টি দেখভাল করে থাকে।
তবে মামলায় আইনী সহায়তা দেওয়ার জন্য দলের কেন্দ্রীয়ভাবে মামলা ও গ্রেফতার নিয়ে কোনো তদারকির ব্যবস্থা নেই। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে সারাদেশে নেতাকর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেফতার বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি কেউ।
এছাড়া আইনী সহায়তার বিষয়টি তৃণমূল নেতাকর্মীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন না করা, সহায়তাদানে দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি কারণে তৃণমূলের সঙ্গে জাতীয় লিগ্যাল এইড কমিটির ফলপ্রসূ কোনো সম্পর্কই তৈরি হয়নি।
দলীয়ভাবে নেতাকর্মীদের সহায়তার ব্যাপারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘দল থেকে নেতাকর্মীদের সরাসরি সাহায্য-সহযোগিতা না করা হলেও নেতারা কর্মীদের খোঁজ-খবর অবশ্যই রাখেন। তারা সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করেও থাকেন।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আটক নেতাকর্মীদের বিষয়ে আমরা আইনী সহায়তা দিয়ে থাকি। দল থেকে না হলেও স্থানীয় ভিত্তিক নেতারা কর্মীদের অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকি।’
বিএনপির আরেক আইনজীবী এ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘রাজনৈতিক মামলার শিকার হয়ে যেসব নেতাকর্মী আদালতে আসেন, আমরা তাদের আইনী সহযোগীতার ব্যাপারে সর্বাত্বক চেষ্টা করে থাকি।’
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫