পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই দলে ফিরতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন বিএনপির সংস্কারপন্থি নেতারা। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। সিগন্যাল পাওয়ার পর আগের মতোই দলে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার মনোভাব দেখা গেছে এক-এগারোর সরকারের সময়ের এসব সংস্কারপন্থিদের।
হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে থেমে গেছে বিএনপির সংস্কারপন্থি নেতাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। দলের মধ্যে কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং নীতিনির্ধারকদের চিরায়ত ধীরে চলো নীতির কারণেই দীর্ঘ ১০ বছরের ওপরে বাইরে থাকা প্রভাবশালী নেতাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। যার কারণে একদিকে কথিত সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতারা হতাশ হয়ে পড়ছেন তেমনি তৃণমূল নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন।
অপরদিকে বিএনপিদলীয় সূত্র জানিয়েছে, ১০ বছর আগে দলে সংস্কার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিভক্তির রেখা মুছে ফেলার উদ্যোগ নেয় দলটির হাইকমান্ড। দলের কট্টরপন্থিদের বিরোধিতার পরও সংস্কারপন্থি হিসেবে বহুল আলোচিত নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া হিসেবে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে দলের সাবেক দুই এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল ও জহির উদ্দিন স্বপনকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অতীতের সব ভেদাভেদ ভুলে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দলের জন্য কাজ করতে বলেছেন তিনি। পর্যায়ক্রমে সংস্কারপন্থি অন্য নেতাদেরও ডাকা হবে এমন ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছিল ওই সময়ে।
দলের নীতিনির্ধারকদের এমন মনোভাবে একদিকে যেমন নেতাকর্মীদের মাঝে উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়, তেমনি দলের বাইরে থাকা এক সময়ের হেভিওয়েট নেতারাও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দলের অন্যান্য যে কোনো কার্যক্রমের মতো এ সিদ্ধান্তটিও থমকে গেছে। কবে কখন তাদের দলে ফিরিয়ে আনা হবে তা এখন কেউ বলতে পারছেন না। এরপরও তারা যোগাযোগ রাখছেন বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করছেন। এরপরও ফলপ্রসূ কোনো সম্ভাবনা দেখা না গেলে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সংস্কারপন্থি নেতারা। এমনটাই জানা গেছে ওইসব নেতার সঙ্গে আলাপকালে।
জানা গেছে, ১/১১ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ২০০৭ সালের ২৫ জুন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলের অভ্যন্তরে ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিলে দলের ১২৭ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি তাকে সমর্থন দেন। সেই থেকে ওই অংশটি সংস্কারপন্থি বলে বিএনপিতে চিহ্নিত। সংস্কার প্রস্তাবের পর খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন, দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে বহিষ্কার করেন। সে সময় দলের মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ পান প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যেও বিএনপিকে ছেড়ে যাননি একসময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ এসব নেতা। এরপর সবাইকে নিয়ে কমিটি হবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার এমন আশ্বাস বাস্তবায়নের অপেক্ষায় ছিলেন সংস্কারপন্থি নেতারা। কিন্তু গত বছরের দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে ৬ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণাতে তাদের কাউকে অন্তর্ভুক্ত না করায় আশাহত হন তারা। এরপরও তারা চেষ্টা করে গেছেন দলে কাজ করার জন্য। এর অংশ হিসেবে দলের চেয়ারপার্সন সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত দুই নেতাকে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে একটি সিগন্যাল দেন অন্যান্যদেরও তিনি দলে অন্তর্ভুক্ত করবেন। কিন্তু এবারো কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত দলের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রবল আপত্তির মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকেও অনেকটা পিছু হটতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। এমনটাই জানিয়েছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র।
সংস্কারপন্থি ইস্যুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কারপন্থিরা অন্য দলে যাননি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তারা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে চলেছেন। ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর সংস্কারপন্থি কিছু নেতা দলে নেয়া হলেও এবার বাকিদের নেয়া হয়নি। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তেমনটা না হলেও পরবর্তী দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অন্যান্য যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গেও দলের হাইকমান্ডের কথা বলা উচিত।
সংস্কারপন্থি অংশের এক নেতা অনেকটা ক্ষোভ এবং হতাশার সুরে বলেন, আমরা ২০০৯ সালের কাউন্সিলের পর থেকে অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে সুযোগ পেলেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মিলাইনি। গত কমিটির মতো এবারো আমাদের জায়গা দেয়া হয়নি। আবার হঠাৎ করে দলে চেয়ারপার্সন আমাদের মতো দুই নেতাকে ডাকলেন, কথা বললেন, আশ্বস্থ করলেন। কিন্তু ওই প্রক্রিয়াটা এখন আবার বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের অপরাধটা কি? আর কত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা কি মরে গিয়ে প্রমাণ করব যে, আমরা খালেদা জিয়া নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।
সূত্র জানায়, দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত একটি অংশ সংস্কারপন্থিদের দলে ফিরিয়ে আনার পক্ষে মনোভাব পোষণ করলেও কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত একটি ক্ষুদ্র অংশ তার বিরোধিতা করছে। দলের ভেতর এ অংশটির প্রভাব কমে এলেও চেয়ারপার্সনের গুড বুকে থাকার কারণে তারা প্রভাব ফেলছেন বলে জানা যায়।
সংস্কারপন্থিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারী শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকাসহ দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। আর এখনো সংস্কারপন্থিদের দলে ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে আগের অবস্থানে অনড় দলের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ প্রমুখ। এমনটি জানা গেছে বিভিন্ন সূত্রে।
উদারপন্থি হিসেবে পরিচিত এমন এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, বলা যাচ্ছে না, অন্য দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেই এখন একটি অংশ তৎপর কিনা। আর এটি হয়ে থাকলে ওই সংস্কারপন্থিদের তুলনায় অনেক ক্ষতি হবে দলের। কারণ এসব নেতার মধ্যে এমন কিছু নেতা রয়েছেন যাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের মাথাব্যথার অবশ্যই কারণ আছে।
সংস্কারপন্থির অভিযোগে দলের পদবঞ্চিত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জেডএ খান ও মোফাজ্জল করিম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহ মো. আবুল হোসাইন, সাবেক হুইপ ও পিরোজপুর জেলার সাবেক সভাপতি সৈয়দ শহীদুল হক জামাল, সাবেক হুইপ রেজাউল বারী ডিনা, দলের সাবেক দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, সাবেক এমপি ও দলের সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতি নজির হোসেন, সাবেক এমপি ও চাঁদপুর জেলার সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান টিটু ও সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হায়দার খান, সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামান, সাবেক এমপি ও দলের বরগুনা জেলার সভাপতি নূরুল ইসলাম মনি, সাবেক এমপি শামীম কায়সার লিঙ্কন, বগুড়ার সাবেক দুই এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা ও জিএম সিরাজ, সাবেক এমপি মোশাররফ হোসেন মঙ্গু, বরগুনা জেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি ইলেন ভুট্টো প্রমুখ।
অন্যদিকে এসব নেতার সমর্থক ও কর্মীরা মনে করেন পবিত্র ইদুল ফিতরের পর বা একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই যদি তাদের নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা যায় সেই ক্ষেত্রে দল অনেক উপকৃত হবে। বিএনপির নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সংস্কারপন্থিদের এক কর্মী বলেন, ঈদের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের জন্য রাজপথে লড়াই করবে বিএনপি। সেই সময় রাজপথে সংস্কারপন্থিরা অবস্থান নিলে দল আরো চাঙ্গা হবে।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১:৩০এ.এম, ২৫ জুন ২০১৭,রবিবার