বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৪ বছর আগে আইন করা হলেও কোনোদিন তা প্রয়োগ করা হয়নি। বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তারপরও বাড়িভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য রোধে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতা মূলত ঢাকায় বেশি। ঢাকায় বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রশিদ না দেওয়া, ইচ্ছেমতো ভাড়া বৃদ্ধি, জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, অগ্রিম ভাড়া, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কাজের খরচ, ইউটিলিটি বিল নেওয়ার ক্ষেত্রেও আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না বাড়ির মালিকরা।
অন্যান্য বছরের মতো ঢাকায় প্রায় সব বাড়িওয়ালাই ইতোমধ্যে আগামী জানুয়ারি থেকে ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছেন ভাড়াটিয়াদের। এ বৃদ্ধির পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন ভাড়াটিয়ারা।
সরকার ১৯৯১ সালে ‘বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগেরও বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আইনটি প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। কিন্তু পরে এ সব কিছুই আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে গত ১ জুলাই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ছয় মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠন করতে বলে উচ্চ আদালত। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।
এ সব বিষয়ে জানতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়া আইন যেহেতু আছে, আইন বাস্তবায়নও হবে। ইফেকটিভলি কার্যকর হচ্ছে কিনা— তা ইমপ্লিমেন্টশনের (বাস্তবায়নের) ওপর নির্ভর করে। আইনটি বাস্তবায়নে বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়াসহ সকলের সহযোগিতা লাগবে।’
আইন বাস্তবায়নে ২৪ বছরেও নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেওয়া হয়নি— এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এগুলো বাস্তবায়িত হয়ে যাবে, একটু সময় লাগবে।’
কমিশন গঠনে আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘হাইকোর্ট যখন এ নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই দেখব।’
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই হার পুনর্নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে দিয়েছি। আইনটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু কেউই তা আমলে নিচ্ছে না। এ সুযোগে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে।’
‘ঢাকার ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া থাকে, বাকিরা বাড়িওয়ালা’ উল্লেখ করে মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই ভাড়ার রশিদ দেন না। চুক্তি করেন না। কোনো বাড়ির মালিক চুক্তি করলেও সব শর্ত থাকে নিজের পক্ষে। জোর করে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ, ইচ্ছেমতো ভাড়া বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো সবার চোখের সামনে হচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নাই। বাড়িভাড়া এখন লাভজনক বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।’
ঢাকায় বাড়ির মালিকরা সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি করছেন জানিয়ে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এ অবস্থা নিরসনে সরকার পদক্ষেপ না নিলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার বিরোধ বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেবে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূইয়া বলেন, ‘বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে ঢাকায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে বাড়ির মালিকদের খেয়াল খুশি মতো। ভাড়াটিয়াদের আয়ের বড় অংশটি চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়ায়। সরকারের কাছে বাড়িভাড়া আইনটি কার্যকর করার দাবি আমাদের বহু পুরনো।’
ঢাকার মাতুয়াইল কবরস্থান রোডের একটি তিনতলা বাড়ির মালিক মো. নুরুল আমিন। তিনি জনতা ব্যাংকে চাকরি করেন। নুরুল আমিন বলেন, ‘অনেক বাড়িওয়ালা আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বাসাভাড়া দেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার স্বার্থটাও দেখেন, এটাও ঠিক। আইন-কানুনের প্রয়োগ না করে কিছু লোকের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ তো সরকারই রাখছে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার সবার স্বার্থ রক্ষা করে আইন হলে সবাই তা মানবে।’
২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বাড়িভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে একটি রিট আবেদন করে। এরপর ২০১৩ সালে রুলের শুনানি শেষ হয়। গত ১ জুলাই রায় দেয় আদালত।
কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়ে আদালতের আদেশে বলা হয়, কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। কমিশনে সদস্য থাকবেন সাতজন। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় সুপারিশ করবে কমিশন। এই কমিশন বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মতামত নিয়ে, প্রয়োজনে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক সর্ব্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে।
বাড়িভাড়া আইনে যা আছে
‘বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১’ অনুযায়ী প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে) ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা যাবে৷ কিন্তু ঢাকায় বছরে দুইবার ভাড়া বৃদ্ধির নজিরও আছে।
ভাড়ার রসিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশের কথা বলা হয়েছে আইনে। বাড়িভাড়া আইনে অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া কোনো অগ্রিম ভাড়া আদায় করা যাবে না। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক মাসের অগ্রিম ভাড়া গ্রহণ করা যেতে পারে।
আইনে বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়িভাড়ার শর্ত মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া চাইবেন ততদিন থাকবেন, তাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন, তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
আইন অনুযায়ী, ভাড়ার আগে দু’পক্ষের মধ্যে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভাড়ার রশিদ দিতে ব্যর্থসহ নানা অপরাধের জন্য জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে।
নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৭:১৮ পিএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫, শুক্রবার
এমআরআর