রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার আব্দুস সাত্তার গত ৭ মে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর বয়স ছিল ৬৪ বছর। ১১ মে তিনি বাড়িতে মারা যান। মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। তাঁকে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মঙ্গলবার আব্দুস সাত্তারের পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, অসুস্থ হওয়ার পর আব্দুস সাত্তার বাড়িতেই ছিলেন। অসুস্থ হওয়ার তিন দিন পর করোনা পরীক্ষার জন্য তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মৃত্যুর পর পরীক্ষার ফল জানা যায়। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কেউ কোনো খোঁজ নেয়নি, বাড়ির অন্যদের সতর্ক থাকা বা কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) অবস্থায় থাকার ব্যাপারে কেউ পরামর্শ দেয়নি। শুধু তেজগাঁও থানা থেকে ফোন করেছিলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা।
করোনার উপসর্গ মৃদু হলে বাড়িতে থেকে চিকিৎসার কথা বলা হচ্ছে। বাড়িতে চিকিৎসার কী পরিস্থিতি, তার ওপর কেউ নজরদারি করছে না। বাড়িতে মৃত্যু বাড়ছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে মৃত্যুর ঘটনা আরও ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সাধারণ সর্দিজ্বর বা সামান্য গলাব্যথা হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু মৃত্যুর তথ্য বলছে, অনেকে তীব্র উপসর্গ বা জটিল উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে থাকছে। মৃত্যুর পর তা জানা যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘রোগীরা কি হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না, নাকি রোগীরা হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না? নাকি বাড়িতে থাকা রোগীদের কেউ ফলোআপ করছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
বাড়িতে মৃত্যু
৭ জুন অনলাইন সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেছিলেন, ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল হাসপাতালে, ১২ জনের বাড়িতে। ওই দিনের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২৮ শতাংশ মৃত্যু হয়েছিল বাড়িতে।
এর আগে ২ জুনের সংবাদ বুলেটিনে নাসিমা সুলতানা বলেছিলেন, ২৪ ঘণ্টায় ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। ২ জুনের হিসাবে বাড়িতে মৃত্যুহার ছিল ২৪ শতাংশ। তবে সব সময় বাড়িতে কত মৃত্যু হচ্ছে, তা প্রকাশ করে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ৮ ও ৯ জুনের বুলেটিনে বাড়িতে মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি শাখা বলছে, প্রায় ২০ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে বাড়িতে। ওই শাখা ১৫ মে থেকে মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৮৮ জনের। এর মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন ৪৫৩ জন, বাড়িতে ১১৯ জন এবং রাস্তায় মারা গেছেন ১৬ জন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন বাড়িতে মৃত্যুর সংখ্যাটা অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘অনেকে হয়তো হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেন। শেষ মুহূর্তে বাড়ি থেকে হাসপাতাল অথবা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা যান। অনেকে হয়তো হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হন।’ তিনি আরও বলেন, এসব মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা দরকার।
সাধারণভাবে ৩৩৩ বা স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে মানুষ করোনা সম্পর্কে উপদেশ বা পরামর্শ পায়। কিন্তু জরুরি সময়ে মানুষ কোন হাসপাতালে যাবে, কোথায় অ্যাম্বুলেন্স পাবে, তা বুঝে উঠতে পারে না। শুরুর দিকে বাড়িতে থাকা রোগীদের সহায়তা করেছে আইইডিসিআর। কিন্তু তারা এখন তা করছে না।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, বাড়িতে যাঁরা চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
অন্যদিকে, জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বাড়িতে থাকা রোগীদের দেখভাল করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব না। স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ে কর্মী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত ব্যক্তির সহায়তার কাজে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাড়িতে করোনা রোগীর চিকিৎসা বা বাড়িতে মৃত্যু বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বাড়িতে রোগীর চিকিৎসা ও মৃত্যু কমিয়ে আনার ব্যাপারেও আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি।’ (প্রথম আলো)
বার্তা কক্ষ,১০ জুন ২০২০