রুপকথার গল্পের মতো বর্তমান যুগের শিশু-কিশোররা শুনছে বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ খেলাধুলার বিভিন্ন আসরের কথা।এ যুগের শিশু-কিশোরদের কাছে মজার খেলা বৌচি,হা-ডু-ডু, নৌকাবাইচ, কানামাছি, গোল্লাছুট, সাঁতচারা, দাড়িয়াবাঁধা,এক্কাদোক্কা, ষাঁড় লড়াই, মোরগ লড়াই, ডাংগুটি, দড়িলাফ, সুঁইসুতা ও তৈলাক্ত বাঁশ খেলা এখন শুধু স্বপ্নের অতীত।
বর্তমান ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মাতামাতিতে নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য এ খেলাগুলো। অথচ মাত্র একযুগে আগেও এসব খেলার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। গ্রামীন খেলাধুলার অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও কলেজ পড়–য়া ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা বিলুপ্ত হওয়ার নেপথ্যের কথা।
মতলব উত্তর উপজেলার ৯নং দক্ষিণ ব্যাসদী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আরিকা আক্তার জানায়,পাঠ্যবইয়ে বৌচি, কানামাছি, নৌকাবাইচ, খেলার নাম শুনেছে কিন্তু এখ নপর্যন্ত সে খেলাগুলা দেখেনি।
এমনকি জানেও না এ খেলাগুলোর নিয়মকানুন। সে আরো জানায়, এখন লেখাপড়া করে খেলার সময় পায় না। শুক্রবার ছুটির দিনেও বাসায় পড়ার চাপ। তাই কোনো খেলাধুলায় তার অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
উপজেলার ছেংগারচর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্র মোঃ শাহরুখ খান জানায়, ছোটবেলা থেকে ফুটবল আর ক্রিকেট-এ দুটো খেলারই প্রচলন বেশি দেখে আসছে। তাই অন্য খেলায় তার আগ্রহ কম। হা-ডু-ডু খেলার নাম শুনেছি।’
বৌচি, কানামাছি, গোল্লাছুট, সাঁতচারা, দাড়িয়াবাঁধা, এক্কাদোক্ক খেলার নাম শুনেছে কিনা প্রশ্ন করলে সে জানায়, নাম শুনে নাই। আর যে কয়টি খেলার নাম শুনেছে তাও আবার জানে না খেলার নিয়ম কানুন বা খেলার কৌশল জানা নেই।
ষাটোর্ধ মো. শাহজাহান খান বলেন, আমাদের কৈশরকালে আমরা কতরকম খেলা খেলেছি। এখন আর ওইসব খেলা দেখা যাায় না। এমনকি বর্তমান যুগেও ছেলেমেয়েরা ওইসব খেলার নামও জানে না।
তিনি আরও বলেন, তখনকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতা ছিল নৌকাবাইচ ও হা-ডু-ডু খেলা। প্রতিযোগিতা হতো বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে। নদীগুলোতে দেখাযেত,দুই তীরে হাজার হাজার গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে রংবেরংয়ের নৌকা সাজিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে বিভিন্ন গ্রামের যুবকরা।
এক সময়ের গ্রামীণ জনপ্রিয় খেলাধুলাগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কারণ সর্ম্পকে উপজেলার মাথাভাঙ্গা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক মোঃ রাশেদুজ্জামান বলেন, এখন আর আগের মতো খেলাধুলার পরিবেশ নেই। এছাড়া এ যুগের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া নিয়েই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে।
যতটুকু অবসর পায়, টিভিতে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলা দেখেই সময় কাটায়। তাছাড়া গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী হা-ডু-ডু,বৌচি,কানামাছি খেলা এখন এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে অজানা।
স্কুল-কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসরেও বিলুপ্ত প্রায় এ খেলার প্রচলন নেই। একাধিক অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন আর বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য খেলার মাঠ নেই। মতলবে ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বেরী বাঁধ হওয়ায় তিনবার মৌসুমী ধান চাষ হয়। খালি মাঠ থাকে না।
যে কয়েকটি রয়েছে, তাও আবার বর্ষায় পানিতে তলিয়ে থাকে। আবার শুস্ক মৗসুমে যেসব মাঠে এসব খেলাধুলা হতো তাতে এখন গড়ে উঠেছে বসতঘর। আবার মাঠ থাকলে সেখানে হচ্চে চাষাবাদ।অবসর সময়ে ঘরে বসে টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলা দেখে সময় কাটিয়ে দেয় তারা।
তাদের আর খেলাধুলা করা হয় না।যারাও খেলাধুলা করছে, তারা বেছে নিয়েছে ক্রিকেট। আর এ কারণে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা এ যুগের শিশু কিশোরদের কাছে এখন স্বপ্নের অতীত।
উপজেলা সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আশরাফুল আলম চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, বর্তমানে সরকার গ্রামীণ এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা আবারো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। যার জন্য এখন শুরু হয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ খেলাগুলো পুনরায় চালু করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘গত দু’বছর যাবত চালু হয়েছে এসব হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা। এ বছরও উপজেলায় গত কয়েক দিন আগে উপজেলা মাঠে এসব হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এসব খেলাধুলা চালু রাখার জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
প্রতিবেদক- খান মোহাম্মদ কামাল