লাগামহীন বাজারদরে দিশেহারা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা

একের পর এক করোনার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা যখন অসহায়ত্বের চরমে পৌঁছেছেন, ঠিক সেই সময়ে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারও। ফলে প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য।

এ অবস্থায় সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে তাঁরা ভিড় করছেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের সামনে। কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা। ভিড় বাড়ায় পণ্য কিনতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার পণ্যের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় মুহূর্তেই খালি হয়ে যাচ্ছে টিসিবির পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো। ফলে অনেককে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতেই।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাকে সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১১০ টাকায় আর মসুর ডাল ৬৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা ও পেঁয়াজ ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৬৫ টাকা। যেখানে প্রতি কেজি ডাল বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৯০ থেকে ১১০ টাকা এবং চিনি ৭৬ থেকে ৮৫ টাকায়। সেই তুলনায় টিসিবির ট্রাকে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে পারায় সেখানেই ভিড় করছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা।

গতকাল পলাশী মোড়ে টিসিবির একটি ট্রাকের সামনে দেখা যায় শত শত মানুষের দীর্ঘ লাইন। ট্রাকের বিক্রয়কর্মী ফরিদ জানালেন, প্রতিদিন টিসিবির গুদাম থেকে তাঁদের ৩০০ কেজি ডাল, ৩০০ কেজি চিনি, ৪০০ লিটার তেল ও ৭০০ কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ এক কেজি ডাল, এক কেজি চিনি, দুই লিটার সয়াবিন তেল ও তিন কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারবেন। এর ফলে লাইনে দাঁড়ানো অর্ধেক ক্রেতা পণ্য পাওয়ার আগেই তা শেষ হয়ে যায়।

নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অসহায়ত্ব দেখা গেল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে না পেরে সেখান থেকে টিসিবির ট্রাক চলে যাচ্ছিল অন্য জায়গায়। এ সময় হুড়োহুড়ি করে ট্রাকের পেছন পেছন দৌড়ে যেতে দেখা যায় অনেক ক্রেতাকে। এর মধ্যে একজন জানালেন, একটি ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে পারছেন সর্বোচ্চ ২০০ মানুষ। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, বাজারে যা অবস্থা, তাতে ট্রাক থেকে পণ্য কেনা ছাড়া আমাদের আর উপায় নাই। তাই ট্রাকের সংখ্যা এবং পণ্যের পরিমাণ বাড়ানো দরকার।

এদিকে টিসিবির ডিলাররা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় লাইনে দাঁড়ানো সবার কাছে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব না হচ্ছে না। টিসিবির ডিলার মেসার্স ইসলাম স্টোরের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইদানীং আমাদের ট্রাক সেলে আগের চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও সবাইকে চাহিদামতো পণ্য দিতে পারি না। প্রতিদিন অনেকেই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।

ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন টিসিবির ১৫০ থেকে ১৭০টি ট্রাক পণ্য বিক্রি করছে। আর অন্য সময়ের তুলনায় এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ পণ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে টিসিবির তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিভিন্ন স্পটে কিছু মানুষ আছে, যারা একই পরিবারের কয়েকজন মিলে পণ্য কিনে তা দোকানে বিক্রি করে দেয়। এদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে ইতিমধ্যে আমরা এ বিষয়ে পুলিশকে চিঠি দিয়েছি। এদের ঠেকাতে পারলে সত্যিকারের ক্রেতাদের আর খালি হাতে ফিরে যেতে হবে না।’

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, টিসিবির ট্রাক সেলে একসময় কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে আসত শুধু নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তারা পেশায় কেউ ছিলেন দিনমজুর, কেউ রিকশা বা গাড়িচালক, কেউ গৃহকর্মী। কিন্তু এখন সেই লাইনে পণ্য কিনতে ভিড় করছেন মধ্যবিত্তরাও।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক অধ্যাপক নাজমা বেগম বলেন, ‘মহামারি করোনার কারণে দেশে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এর প্রভাব সরাসরি আমাদের অর্থনীতিতে পড়েছে। রাজধানীর একটা বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।’

বাজারে যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং মধ্যবিত্তরা তখন আরও বেশি অসহায় পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেন অধ্যাপক নাজমা বেগম।

Share