শীর্ষ সংবাদ

বাখরাবাদ নির্বিকার : এবার অবৈধ গ্যাস যাচ্ছে কামালায়

কুমিল্লা করেসপন্ডেন্ট  আপডেট: ০১:২৪ অপরাহ্ন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫,  মঙ্গলবার

এবার গ্যাস যাচ্ছে কামালায়। এজন্যে ব্যাপক খুড়াখুড়ি চলছে মুরাদনগর-রামচন্দ্রপুর সড়কে। ১৭ সেপ্টেম্বর এমন এক সংবাদ পেয়ে গ্যাসের অবৈধ পাইপ লাইনের সন্ধানে, রওয়ানা করি কামালার উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাটা তখন বিকেল ৪টার ঘরে। আমরা ক’জন সংবাদকর্মী একুশে টেলিভিশনের প্রতিনিধি’র প্রাইভেট কারে চড়ে যাচ্ছি। আমাদের গাড়িটি রামচন্দ্রপুর সড়কে মুরাদনগর থেকে কিছু দুর যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ে রাস্তার ডান পাশে (পশ্চিম পাশ) কালো স্কচটেপ মোড়ানো ২ ইঞ্চি ব্যাসের একটি পাইপ লাইন চলে গেছে মাটির নীচ দিয়ে। ক’দিনের বৃষ্টিতে মাটি সরেগিয়ে পাইপটি ভেসে ওঠেছে। দৃশ্যটি ভিডিও করলাম আমরা।

এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছু দুর নেয়ামতপুর গ্রাম। সেখানে হাতের ডানে দেখা মিললো একটি সার-কিটনাশকের দোকানে বসে আছেন একজন বয়স্ক ব্যাক্তি। চাচা ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নাম? আমার নাম মো: সেকোল মিয়া। চাচার উচ্চারণটি স্পষ্ট ছিলোনা। যাইহোক, চাচাকে প্রশ্ন করলাম- এই পাইপ লাইন যাচ্ছে কোথায়? চাচা বললেন, কামালায় গ্যাস যাচ্ছে। আপনার বাড়িতে গ্যাস নিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চাচা- না, নেইনি। কারন, আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি এটি সরকার অনুমোদিত কি না। তাছাড়া ওরা এক চুলা বাবদ ৮৫ হাজার করে টাকা চায়। এতো টাকা দিয়ে আমরা নিতে আগ্রহী না। কোন দিন সরকারী ব্যবস্থাপনায় এলেই গ্যাস নেব।

চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। অনেক স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে টানা হচ্ছে পাইপ লাইন আমারা দেখতে পেলাম। এগুলোতে যানবাহনের চাকার চাপে যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিছু দূর যেতেই দেখগেলো একটি বাড়িতে রাখা পাইপের স্তুপ। একদল যুবক সেখান থেকে পাইপ একটি সেলোইঞ্জিন চালিত নসিমনে তুলছে। ওদের নাম পরিচয় জানতে চাইলাম এবং জানতে চাইলাম পাইপগুলো কার? ওদের সোজা উত্তর- ’এতো কিছু আমরা জানি না, শুধু জানি আমরা খায়ের কন্টেকটারের কাম করি।’ জানতে চাইলমা খায়ের কে? জবাবে বললো- ’পাইন্নার পুলের খায়ের, সাম্বাদিক খায়ের।’ এর বেশি কিছুই বলতে রাজি হলো না ওরা।

আবারও ছুটে চললাম সামনের দিকে। এক পর্যায়ে চোখে পড়লো সে দৃশ্যটি, যে সংবাদে আমরা সেখানে গেলাম। অর্থাৎ রামচন্দ্রপুর-মুরাদনগর সড়কে বিশাল ড্রেন (নালা) করে পাইপ লাইন টেনে নেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, সড়ক বিভাগের সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের অনোমোদন ছাড়া কি করে এতোবড় ড্রেন করে পাইপলাইন টানা হচ্ছে। সে যাই হোক ইতিমেধ্যই কয়েক জন যুবক মোটরসাইকেলে করে কয়েকবার আমাদের ফলো করে গেছে। দেখে মনে হলো এরা অবৈধ সংযোগ কাজের ঠিকাদারের লোক।

লোকজন জানালেন এধরনের সংযোগের কাজ শুরুতে রাতের বেলায় করা হতো। কিন্তু এখন তা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে দিবালোকে। দিন দিন যেন আরো শক্তিশালী ও গতিশীল হয়ে উঠেছে চক্রটি।

যেতে যেতে কামালার বাজারে গিয়ে একটি চাস্টলে কিছু মুরুব্বী কিসিমের লোক দেখতে পেয়ে তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বললাম আমরা। আলাপ কালে অনেক তথ্য জানা গেলো। তাদের কেউ কেউ জানালেন গ্যাস সংযোগে তার ভীষণ খুশি। কিন্তু পরবর্তীতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে যদি তুলে নেয়া হয় এমন সঙ্কাও রয়েছে তাদের মনে। তারা জানালেন প্রতিটি রাইজার বাবদ তাদের কাছ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা।

সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে বাকী রইলো না গ্যাসের অবৈধ সংযোগের মহোৎসব চলছে এখানে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের এই রমরমা বানিজ্যের ফলে থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সন্ধ্যায় আমরা কামাল¬া থেকে ফিরে এলাম কুমিল্লায়। আমাদের কাছে ফোন আসতে থাকে নানান দিক থেকে। চেনা অচেনা নাম্বার থেকে। শঙ্কায় অনেক ফোনই ধরিনি।

কুমিল্লা আসতেই আমাদের কাছে সংবাদ আসতে থাকে বর্তমানে মুরাদনগর উপজেলার কামালায় ছাড়াও ধামঘর, করিমপুর, রহিমপুর, নগরপাড়, বাখরনগর, ছালিয়াকান্দি, গকুলনগর, ত্রিশসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম এবং বোড়ারচর থেকে জাহাপুর পর্যন্ত ৩০ হাজার ফুট এবং ভুবনঘর থেকে দরিকান্দি হয়ে দুলারামপুর পর্যন্ত ১১ হাজার ফুট পাইপলাইন নির্মান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি।

নির্মানাধীন এসব সংযোগ বাবদ প্রতি গ্রাহক থেকে নেওয়া হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। যা থেকে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অন্যদিকে চক্রের সদস্যরা বনে যাচ্ছেন কোটি কোটিপতি। ফলো এরা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠছে।

’আমাদের গ্যাস আমদের অধিকার’ সংগঠনের সমন্বয়ক অ্যডভোকেট খন্দকার তানভীর আহমেদ ফয়ছাল এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন- মুরাদনগরের পালাসুতা ও কামালার মতো এভাবে খাল-নদী-সড়ক কেটে অবৈধ সংযোগে আমরা গ্যাস পেতে চাই না। কারন এতে গ্রাহকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি সরকারও হারাবে রাজস্ব। তিনি বলেন, মুরাদনগরের ০৫টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে আমরা চাই বৈধ উপায়ে গ্যাসের সংযোগ পেতে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও দালাল চক্র বাখরাবাদ গ্যাস ডিসট্রিবিউশন কোম্পানীর অফিস ও দেবিদ্বার জোনাল অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজস রয়েছে। এদের সম্মিলিত প্রভাবশালী চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গ্যাসের আবাসিক সংযোগ দিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে সাধারন গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। শুধূ কোটি কোটি বললে ভূল হবে, শত শত কোটি টাকা।

যেখানে দু’ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগের কোন প্রকার বৈধ্যতা নেই। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর কুমিল্লার অফিস ও দেবিদ্বার জোনাল অফিসের পক্ষ থেকে এসব সংযোগকে মুখে অবৈধ বললেও, ন্যাপথ্যে তারাই এ সুযোগ করে দিচ্ছেন অবৈধ টাকার বিনিময়ে।

অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পাকা সড়ককে খাল বানিয়ে গ্যাস সংযোগের পাইপ টানা হচ্ছে অবৈধ ভাবে। তা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা কেন নীরব ভূমিকায়, এ প্রশ্নে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

এ গ্যাস চোরাই সিন্ডিকেট গুলো বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছেনা। কেউ প্রতিবাদ করলেই আসে হত্যার হুমকী, নয় চাঁদাবাজী মামলা।

এ অবৈধ গ্যাস সংযোগের মহোৎসবের বিষয়ে সোচ্চার স্থানীয় কিছু সাংবাদিক। এদের বিরুদ্ধে গত ১৫ আগস্ট মুরাদনগর থানায় মজিবুর রহমান খোকন বাদি হয়ে বাংলাভিশন টিভির প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন ও দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা মোশাররফ হোসেন মনিরের বিরুদ্ধে একটি চাদাঁবাজির মামলা দায়ের করেন। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। জানাগেছে ধামঘর গ্রামের আব্দুর রহমান মোল্লার ছেলে মজিবুর রহমান খোকন একজন গ্যাসের অবৈধ সংযোগ প্রদানকারী চক্রের সদস্য।

পালাসূতা গ্রামের জন প্রতিনিধি কবির মেম্বার শোনালেন লোমহর্ষক কাহিনী। গ্যাসের অবৈধ সংযোগের বিরোধিতা করায় জীবন্ত কবর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি জানান, শুধুমাত্র তার গ্রামেই প্রায় ৮’শ রাইজার বসানোর টার্গেটে ইতিমধ্যেই প্রায় ২শতাধিক রাইজার লাগিয়েছে দালাল চক্র। প্রতিরাইজার থেকে ০১ লাখ করে টাকা নিলে মোট টাকার অংক দাঁড়ায় ০৮ কোটি টাকা। এই অবৈধ লাইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় কবির মেম্বারকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় চক্রটি। পরে মারধর কওে রাতের আঁধারে নির্জন কবরস্থানে জীবন্ত মাটি চাপা দেওয়ার চেষ্টাকালে স্থানীয় জনগন তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এ বিষয়ে কুমিল্লার আদালতে দায়ের করা একটি মামলা তদন্তধীন। কবীর মেম্বার জানান, যুগান্তর ও আর টিভির এক সাংবাদিক এই চক্রের সাথে জড়িত থাকায় চক্রটি নিজেদের আরো শক্তিশালী মনে করছে।

এদিক জেলার বড়ুরা, দাউদকান্দি, ময়নামতি সেনানীবাসের আসপাশের এলাকাসহ চান্দিনা উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও চলছে অবৈধ সংযোগের হিড়িক।

এব্যপারে জানতে বাখরাবাদ গ্যাস ডিসট্রিবিউশনের লিমিটেড অফিসে গিয়েও কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। সাংবাদিকদের দেখে কর্মকর্তা এমন চরম ব্যস্ততার ভাব দেখালেন যে কাজের চাপে তাদের নাওয়া খাওয়াই বন্ধ হয়েগেছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাখরাবাদ গ্যাস ডিসট্রিবিউশনের লিমিটেড-এর গেলেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর কক্ষে প্রবেশের সুযোগ দেননি ব্যবস্থাপক (সমন্বয়ক) নেয়ামুল আলম খান। বরং রীতিমতো দুর্ব্যবহার করেছেন। নেয়ামুল আলম খান প্রথমেই জানতে চান স্যারকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করবেন, অবৈধ লাইনের বিষয়ে?

এদিকে সেল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বক্তব্য দেয়ার আশ্বাসে দুই ঘন্টারও বেশি সময় বসিয়ে রাখেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিক মোহাম্মদ নিজামুল হাসান শরীফ। দু’ঘন্টা পরে সেল ফোনে তার সাথে পূনরায় যোগাযোগ করা হলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন ‘তিনি কথা বলবেন না’।

এব্যপারে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো: হাসানুজ্জামান কল্লোলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এভাবে অবৈধ উপায়ে গ্যাসের সংযোগের বিষয়ে আমি বাখরাবাদকে চিঠি দিয়েছি, পাশাপাশি মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছি। তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যেমে এগুলো অপসারন করা হবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, এধরনের গ্যাস সংযোগের সাথে যদি কোন সাংবাদিক জড়িত থাকেন তবে তা অত্যন্ত দূ:খজনক। পাশাপাশি এই অবৈধ সংযোগের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কোন ব্যাক্তি কিংবা সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়ে থাকলে তা’ও দু:খ জনক। কারন তারা সরকারী সম্পত্তি রক্ষায় কাজ করছে। আমি পুলিশ সুপারের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।

Share