সারাদেশ

বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত

আজ আমরা মায়ের ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি যে সকল কালজয়ী মহান ব্যাক্তিদের অক্লান্ত ত্যাগের কল্যাণে; তাদের অন্যতম শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক একুশের চেতনা মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে। আমাদের জাতি সত্ত্বার শ্রেষ্ঠতম পরিচয় বহন করে একুশ। এই একুশের গোড়ায় ছিলেন কুমিল্লার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নবগঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে গঠিত ‘পাকিস্তান গণপরিষদ’ এর অধিবেশনে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে; এ প্রশ্নে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবি আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করেন সেদিন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি। করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি দাখিল করেন। মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, উর্দুুর সাথে ইংরেজিও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। একই বছরের ২৫ ফেব্র“য়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজির পর ‘বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান।

অবশেষে ১৯৫০ সালে গনপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লিখার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে রক্ত ঝরে। ২২ ফেব্র“য়ারী এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার (তৎকালীণ ত্রিপুরা) ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার রামরাইল গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। ১৯১০ সালে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কিছু সময় শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তিনি পাকিস্তান মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তাঁর নাতনি আরমা দত্ত (ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদশী) জানান, ‘পেশা, রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরুকরে সবই ছিলো কুমিল্ল¬া কেন্দ্রিক। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কুমিল্লার ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড় তাঁর নিজহাতে গড়া এই বাড়িটিতে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ২৯ মার্চ রাতে পাঁক হানাদাররা মহান ভাষা আন্দোলনের মহা নায়ক ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে কুমিল্ল¬ার নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। হানাদারদের হাতে শহীদ হন বাংলা ভাষার প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।’

১৯৪৮ সারাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরেছিল কুমিল্ল¬ায়। কুমিল্ল¬া আরেক কৃতী পুরুষ রফিকুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্র“য়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা আন্দোলনের সুতিকাগার এই কুমিল্ল¬ায় ভাষার প্রাণপুরুষদের স্মৃতি চরম অবহেলিত।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাক হানাদাররা হত্যা করেছিলো, সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন পরিণত হয়েছে রিক্সার গ্যারেজ, ঝোপঝার আর পরিত্যক্ত বাড়িতে। বাড়িটিতে রয়েছে পৃথক তিনটি ভবন। পশ্চিম উত্তর এবং পূর্ব পার্শ্বে তিনটি পাঁকা ভবনের মোট ৬টি কক্ষ অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থা। পানি জমে এমন হয়েছে যে, দেখে মনে হবে ছোটখাট পুকুর আর নর্দমা। সে মহান মানুষটির স্মৃতি চিহ্ন এমনকি বাস্তুভিটাও অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বর্তমানে বাড়িটির অত্যন্ত করুণ দশা। বাড়িটি দেখভালে দায়িত্বে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। তারা বাড়িটিকে রিক্সা গ্যারেজে পরিণত করেছেন।

ধীরেন দত্তের বাড়ির সামনের রাস্তাটি এবং কুমিল্লা স্টেডিয়মটির নামকরণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আ.ক.ম. বাহাউদ্দিন বাহারের প্রষ্টোয় কুমিল্লা স্টেডিয়মটির নামকরণ করা হয় ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম’।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনত সংগ্রাম; সর্বশেষ পাাঁক হানাদারদের হাতে শহীদ হয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

এখন এ বাড়িটি যথাযথ সরক্ষণের বিষয়ে সরকারের হস্থক্ষেপ কামনা করছেন কুমিল্লাবাসী। নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. আলী হোসেন চৌধুরী, গল্পকার ও উপন্যাসিক প্রফেসর এহতেসাম হায়দার চৌধূরী, ঐতিহ্য কুমিল্লার পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুলসহ কুমিল্লার সচেতন নাগরিকরা তাঁর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি এভাবে অযত্নে ফেলে না রেখে এখানে একটি সমৃদ্ধ যাদুঘর স্থাপন জরুরী মনে করছেন। তারা বলেন, কুমিল্লার যে মহান পুরুষটি ভাষা আন্দোলনে প্রথম বীজ বপন করেছেন তাঁর বাড়িটিই আজ চরম অবহেলিত, রিক্সার গ্যারেজ! বিষয়টি সুশীল সমাজের কেউ মানতে পারছেন না।

তবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরসূরীরা বাড়িটি সরকারি ব্যাবস্থাপনায় দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল

Share