Home / বিশেষ সংবাদ / বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতির বিয়ের রীতিনীতি
বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতির বিয়ের রীতিনীতি

বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজাতির বিয়ের রীতিনীতি

জন্মগতভাবেই মানুষ সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন রক্তের এই বন্ধনগুলো মানুষকে আলাদাভাবে তৈরি করে নিতে হয় না। তবে এই সম্পর্কগুলোর ভিতর সবচেয়ে কোমল হয় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। সামাজিক রীতিতে বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই সম্পর্কে কোনো রক্তের টান থাকে না, থাকে কেবল ভালবাসার সম্পর্ক। বিভিন্ন রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে দুজন পরিণত তরুণ-তরুণীর সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবার জায়গা ভেদে এসব রীতিনীতির পার্থক্যও থাকে অনেক।

সাধারণভাবেই বিয়ের এসব রীতিনীতি বেশ উপভোগ্য। তবে সেখানে আরও আকর্ষণ তৈরি হয় যখন ভিন্ন সংস্কৃতির বিয়ের সাক্ষী হওয়া যায়। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকৃত বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বিয়ের রীতিনীতিও বেশ নজরকাড়া। বাংলাদেশের মিশ্র সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদান রাখা নৃগোষ্ঠী চাকমা, মারমা, সাওতাল, ম্রো, মণিপুর সহ আরও কিছু সম্প্রদায়ের আকর্ষণীয় এসব বিয়ের রীতিনীতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

মারমা
মারমা শব্দটি ‘ম্রাইমা’ থেকে এসেছে। মারমারা সাধারণত পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে আগত এবং এদের বেশিভাগই বান্দরবানে বসবাস করে। অন্যান্য আচার-আচরণের মতো বিয়ের রীতিনীতিতেও বেশ তফাৎ দেখা যায় তাদের।

মারমা নৃগোষ্ঠীতে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ থাকলেও পরিবারের ভিতরেই যেমন চাচাতো, ফুফাতো কিংবা মামাতো ভাইবোনের বিয়ের সম্পর্ক বেশ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত পাত্রপক্ষই বিয়ের আলাপ শুরু করে। এরপর পাত্রপক্ষ আত্মীয়স্বজন মিলে ১ বোতল মদ, ১ বিড়া পান, ২৫টি সুপারি, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, ১ জোড়া নারিকেল ইত্যাদি নিয়ে পাত্রীর পিতা-মাতার সাথে দেখা করতে যায়। পাত্রীর পিতামাতা সম্মতি জানালে পাত্রীর মতামত নিয়ে তারাও অনুরূপ ১ বোতল মদ পাত্রপক্ষকে দেয়। এভাবে মত বিনিময়ের মাধ্যমে সম্মতি নিয়ে রাশিফল দেখে বিয়ের দিন-লগ্ন ধার্য করা হয়। এরপর ‘লাকপাইং ছোয়ে’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় মূলত পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে বিয়ের ব্যাপারে জানানোর উদ্দেশ্যে।

সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে পাত্রপক্ষ থামি ও সোনা বা রূপার আংটি দিয়ে মেয়েকে আশীর্বাদ করে আসে। এরপর বিয়ের দুদিন আগে বরের বাড়িতে ‘চুং মং লে’ পূজার আয়োজন করা হয় তাদের গৃহ দেবতাকে উদ্দেশ্য করে। এই পূজায় দেবতাকে উদ্দেশ্য করে একটি শূকর ও পাঁচটি মোরগ উৎসর্গ করা হয়। এরপর বিয়ের দিন পাত্রপক্ষ ১টি সিদ্ধ মোরগ, মদ, থামি, অলংকার সহ আরও সামগ্রী নিয়ে যায়। বিয়ের পর সিদ্ধ মোরগ খাওয়ার উপযুক্ত রান্না করে বর-কনের সামনে পরিবেশন করা হয়। বিয়ের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পঞ্চশীল গ্রহণ, পিন্ড দান ও মঙ্গল সূত্র পাঠ করানো হয়। এরপর নব-বিবাহিত দম্পতি পিতা-মাতা সহ উপস্থিত সকলের আশীর্বাদ গ্রহণ করে বিয়ের পূর্ণ রীতি সম্পন্ন করে।

চাকমা
বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীর ভিতর জনসংখ্যার দিক দিয়ে চাকমা সম্প্রদায় সবচেয়ে বৃহত্তর। চট্টগ্রাম, বান্দরবন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় চাকমাদের দেখা যায়। চাকমাদের বিয়ের রীতিনীতিতেও অনেক ভিন্নতা দেখা যায়।

বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ কোনো মেয়েকে পছন্দ করে প্রস্তাব পাঠায়। এসময় পাত্রের আত্মীয়দের কেউ পান-সুপারি, মদ, নারিকেল, শুঁটকি, পিঠা-পুলি ইত্যাদি সহ মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে যায়। তাদের ভাষায় এই প্রস্তাব পাঠানোকে বলে ‘উদা লনা’। এরপর পাত্রীপক্ষ গোপনে পাত্রের খোঁজ নিয়ে বিয়েতে সম্মতি দেয়। তবে একবার সম্মতির পর কোনো পক্ষ বিয়েতে নারাজ হলে তাদের অন্যপক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ‘লাজভার’ দিতে হয়। এছাড়া দুইপক্ষের সম্মতির পর ওই কন্যাকে অন্য কেউ প্রস্তাব দিলে সেটাও অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় চাকমাদের ভিতর।

চাকমা নৃগোষ্ঠীতে পণ দিয়ে কন্যা আনার রীতি রয়েছে। তাই বিয়ের আগেই পণ নির্ধারণের জন্য পাত্রপক্ষ পুনরায় পাত্রীপক্ষের বাড়ি যায়। বিয়ের পণ হিসেবে সাধারণত বরপক্ষ কনেদের নগদ টাকা, চাল, দ্রব্যসামগ্রী, শূকর, অলংকার প্রভৃতি দিয়ে থাকে। পণ দেওয়ার এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘উবোর খজ্জি’। এরপর বিয়ের দিন নির্ধারিত হলে বরপক্ষের বউ আনতে যাওয়ায় রীতিকে বলে ‘বউ হজা যেয়ে’ এবং বউকে বাড়িতে পৌঁছে দেবার দলকে বলে ‘বউ বারে দিয়া’। এরপর বউকে বাড়িতে তোলার পূর্বে বরের ছোট ভাই বা বোন বা কোনো আত্মীয় কনের পা ধুয়ে দেয়। এরপর বরের মা বা কোনো সধবা দরজার দুইপাশে রাখা ‘মঙ্গল কলসী’তে বাধা সাত প্রস্থ সুতা কনের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে বেঁধে দেয়।

চাকমারা বিয়ের এই অনুষ্ঠানকে বলে ‘চুমুলাং’। চুমুলাং অনুষ্ঠানের রীতিনীতি পালনে একজন পুরোহিত থাকেন। চাকমা সম্প্রদায়ের দেবী পরমেশ্বরীর উদ্দেশ্যে মদ, শূকর, মোরগ উৎসর্গ বিয়ের অন্যতম অপরিহার্য রীতি হিসেবে পালিত হয়। চাকমাদের বিয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ‘জদনবানাহ্’। এই অনুষ্ঠানে সদ্য বিবাহিত বর-কনেকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে পূর্ণিমা, চন্দ্রগ্রহণ বা অমাবস্যার সময় চাকমাদের বিয়ের বিধিনিষেধ রয়েছে।

সাঁওতাল
সাঁওতালদের রীতিনীতি অনেকটাই বাঙ্গালী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতো। তাদের বিয়ের আট-দশটি রীতি থাকলেও এখন ‘ইদ্যুৎ’ আর ‘রায়বার’ সবচেয়ে প্রচলিত রীতি। ‘ইদ্যুৎ’ প্রথা অনুসারে কোনো সাঁওতাল পুরুষ কোনো মেয়েকে সিঁদুর পরিয়ে দিলেই তারা বিবাহিত হিসাবে স্বীকৃতি পেত। তবে এই বিয়েতে কনের মতামত একেবারেই প্রাধান্য দেওয়া হতো না। তাই এই রীতির প্রচলন কমে গেছে।

কিন্তু ‘রায়বার’ রীতিতে বিয়ে তাদের ভেতর এখন বেশ জনপ্রিয়। এই রীতিতে পাত্রপক্ষ ঘটকের মাধ্যমে কন্যার খোঁজ পেলে উপহারসহ কন্যার বাড়িতে প্রস্তাব দিয়ে থাকে। এরপর কন্যাপক্ষ তাদের বাড়িতে এলে তাদের কোলে বসিয়ে চুম্বন করে উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে পাত্রপক্ষ কন্যার বাড়িতে গেলেও একইভাবে তাদের আপ্যায়ন করা হয় এবং কনের বাড়িতেই বিয়ের দিন ধার্য করা হয়।

এরপর বিয়ের দিন পাত্রের মা একটি ডালায় আতপ চাল, ডিম, তেল, সিঁদুর, সুতো এবং পাত্রের কাকীমা, পিসিমারা তরোয়াল ও তীর-ধনুক নিয়ে যান। শুভলগ্নে শুভদৃষ্টির মাধ্যমে কনেকে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। সাঁওতালদের বিয়ের সময় বিশেষ কোনো মন্ত্রের উচ্চারণ করা হয় না, কেবল পাত্রীর বিদায়ের সময় জগমাঝি পাত্রকে কিছু কথা শোনান।

মণিপুরি
মণিপুরিদের সাধারণত নিজস্ব সমাজের বাইরে বিয়ে করাটা একেবারেই নিষিদ্ধ। মণিপুরি সম্প্রদায়ে প্রধানত চার ধরনের বিয়ের প্রচলন রয়েছে। সেগুলো হলো প্রজাপাত্য বিয়ে, ব্রাহ্ম বিয়ে, গন্ধর্ব বিয়ে ও রাক্ষস বিয়ে। প্রজাপাত্য বিয়ের নিয়মানুসারে বর-কনের অভিভাবকেরাই বিয়ের সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কন্যা পছন্দের পর বিয়ের দিন নির্ধারণের জন্য পাত্রপক্ষ তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে খই, ফলমূল, নাড়ু, মিষ্টিসহ কনের বাড়িতে যায়। এরপর দুইপক্ষের সম্মতিতে বিয়ের দিন ধার্য হয়।

মণিপুরি বরের বিয়ের পোশাক সাধারণত সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, এছাড়া গলায় মালা ও কপালে চন্দন তিলক টানে। অন্যদিকে কনের পরনে থাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘ঘাগরা’। বিয়ের মন্ত্র, মঙ্গল ঘট ও অন্যান্য আচারের শেষে কনের পিতা-মাতা কনের হাত বরের হাতে সমর্পন করেন। এরপর কনে একটি কাঁচের পাত্রে ফুল নিয়ে সাতবার বরকে প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবার প্রদক্ষিণ শেষে একটি ফুল বরের পায়ে দিয়ে প্রণাম করে নববধু। শেষবার প্রদক্ষিণ করে কনে বরের গলায় মালা পরিয়ে দেয় এবং তারপর বর সেটা পুনরায় কনেকে পরিয়ে দেয়। এভাবেই মালা বদলের মধ্য দিয়ে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হয়।

মুন্ডা
মুন্ডা নৃগোষ্ঠীর ভিতর বিয়েতে পণ প্রথা বিদ্যমান। পাত্র-পাত্রী দুজন দুজনকে পছন্দ করার পর ‘লোটাপানি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে পাত্রপাত্রীকে নতুন পোশাক পরানো হয়। এরপর বিয়ের দিন ধার্য হলে তার একদিন আগেই পাত্রপক্ষ রাতে কনের বাড়িতে আসে। সেখানে সারারাত মদ পান ও আমোদপ্রমোদে ভরপুর হয়ে ওঠে বিয়েবাড়ি। পরদিন সূর্যদয়ের সাথে সাথেই শুরু হয় বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান। সূর্যদেবকে সাক্ষী রেখে কনের মাথায় সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সমাপ্ত হয়। এছাড়া মুন্ডা সম্প্রদায়ে বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে। বিধবারা ‘সাগাই’ নামক এক ধর্মীয় প্রথার মাধ্যমে পুনরায় বিয়ে করতে পারে।

কড়া
কড়া সম্প্রদায়ের বিয়ের রীতিনীতি বেশ আকর্ষণীয়। বর-কনের বাড়ির উঠানে মাড়োয়া তৈরি করা হয়। মাটির ঢেলা উঁচু করে চারপাশে কলাগাছ ও মাঝে একটি বাঁশ পুঁতে বিশেষভাবে এই মাড়োয়া তৈরি করা হয়। এরপর এতে আমের পাতা, প্রদীপ, কলস স্থাপন করা হয়। এছাড়া খড় দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করে তীর-ধনুক দিয়ে বিশেষ কৌশলে ‘বাঁদর’ বানিয়ে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে টানিয়ে রাখে যাতে দূর থেকে বিয়ে বাড়ি বোঝা যায়।

বিয়ের দিন বর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে সুতা বেঁধে মাড়োয়ার কলসীগুলোকে পাঁচবার ঘুরিয়ে বেড়ি তৈরি করে। এরপর সেখানে বসিয়ে তাকে ক্ষীর খাওয়ানো হয়। এরপর নাপিত এনে চুল-দাড়ি কামিয়ে বরের কনিষ্ঠ আঙ্গুল কেটে কিছুটা রক্ত নিয়ে তাতে চাল মিশিয়ে আমপাতায় মুড়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হয় বরের হাতে। একই পদ্ধতিতে কনের বাড়িতেও নাপিত আসে। এরপর দুইদিকেই বর-কনেকে গোসল করানো হয়।

বিয়ের পূর্বে আমের পাতা দিয়ে পানি ছিটিয়ে বরকে স্বাগত জানানো হয়। এরপর প্রদীপ, ঘাস, ধান দিয়ে বরকে আশীর্বাদ করে রুপার আংটি পরানো হয়। বিয়ের মূল উৎসব হলো সিঁদুর পরানো। কড়া সম্প্রদায়ে এই অনুষ্ঠান হয় তাদের চাষাবাদের প্রতীক জোয়ালের উপর। বর-কনে জোয়ালের উপর এক পা তুলে স্পর্শ করে রাখে আর তাদের দুজনকে ঘেরা দেওয়া হয় কাপড় দিয়ে। এরপর বর তার পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে কনেকে সিঁদুর পরিয়ে দেয় এবং উপস্থিত সকলে নবদম্পতিকে ধান দিয়ে আশীর্বাদ করে।

এমন আরো অনেক সম্প্রদায়ের নানা আচার অনুষ্ঠানের ভিন্নতায় জাঁকজমক হয়ে ওঠে একেকটি বিয়ের আসর। বিয়ে মানেই পরিবার, প্রতিবেশীর সমাগমে নবদম্পতির নতুন জীবনে যাত্রার পথে আশীর্বাদ গ্রহণ। তবে দিন বদলের সাথে সাথে এসব রীতিনীতিরও পার্থক্য ঘটে। নতুন নিয়মের অনুপ্রবেশ ঘটে। ভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর বিয়েতে বিয়ের আচার অনুষ্ঠানেও আমূল পরিবর্তন আনে। তবুও তারা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। তাদের ঐতিহ্য সর্বদায় বাংলার মানুষের কাছে চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয়। তাই বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের উৎসবের ভিন্নতার মতো বিয়ের সংস্কৃতিও তাদের জীবনযাত্রার সাথে বেঁচে আছে বাংলার মাটিতে।

নিউজ ডেস্ক
;আপডেট সময় ২:৩০ ১৫ জুলাই ২০১৮ রোববার
কে এইচ

Leave a Reply