খেলাধুলা

‘বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত’

১৯৯৫ সাল। তারিখ, দিন, বার মনে নেই। চমৎকার বিকেল। স্কুল থেকে ফিরছি গোধূলীর লাল আলো গায়ে মেখে। সবুজ ধান খেতের আল ধরে। ক্ষধায় শুকনো মুখ। বাড়ির সন্নিকটে এসে দেখি আমার সমবয়সি একদল কিশোর খেলা করছে।

ওদের স্কুল গ্রামের পাশেই। তাই তারা খেলা করার সময় একটু বেশি পায়। ওই স্কুলে আমিও পড়তে পারতাম। কিন্তু আমার বড় ভাই বোন একটু দূরের স্কুলে পড়ে। স্কুলটিতে ভালো পড়ালেখা হয় এমন সুনাম রয়েছে। তাই আমিও দূরের স্কুলেই পড়ি। পরিবারের ইচ্ছায়; আমার অনিচ্ছায়।

আমাদের বাড়ির উত্তর পাশে একটি পরিত্যক্ত উচু আবাদি জমি। গ্রামে ওমন জমিকে ‘বিচনা’ বলে। দু’ডজন সমবয়সী কিশোর যে খেলাটি করছিলো। এ প্রথম আমি এমন খেলা দেখছি। মনে কৌতুহল জানতে চাই; এটা কি খেলা? নাম কি? যারা খেলছিলো সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

আমি লজ্জ্বা পাইনি। কিন্তু বিব্রত হইনি তা বলবো না। সবশেষ বন্ধুবর মৃত্যুঞ্জয় আমাকে খেলাটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধরণা দিলো। তবে নামটি ভুল বলেছিলো। খুব যতœ করে বলেছিলো; খেলাটির নাম ‘টিকেট’।

নাম যাইহোক; খেলাটা আমার মনে ধরে। প্রেমে পড়ে যাই। খেলার নাম ও নিয়ম শুনেই প্রেমে পড়ি। অবশ্য তার আগে ফুটবল, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, সাতচাঁড়া, দাড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি। এসব খেলার সাথেই সখ্য ছিলো আমার। আগ্রহ দেখে আমাকে তারা খেলায় নিলো। ব্যাটিং করা দলে আমাকে ভিড়ায়। যখন ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেলাম। আমার খেলা দেখে সবাই হতবাক। আমি ব্যাট ঘুরালেই বল মাঠের বাইরে চলে যায়। রান কতো হলো আমি গুণতে পারি না। তখনো চার ছয় হিসেবে আয়ত্ত¡ করতে পারিনি। মাঠের উত্তর পাশে ধান খেত ছিলো। আগেই শর্ত দেয়া ছিলো বল খেতে গেলে রান হবে না। কিন্তু আমি জানতাম না।

আমার খেলা দেখে সহপাঠিরা কোনো ভাবেই বিশ্বাস করছিলো না যে; আমি জীবনে এই প্রথম ক্রিকেট খেলছি। আমার খেলা দেখে তারা অবাক হয়। কিন্তু আমি খুব মজা পাই। অথচ খেলার নিয়ম কানুন কিছুই জানা নেই; মনে নেই। এরপর থেকে সব খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেটে মজে থাকি।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হলো। পাইলটের ছক্কার কথা আজো মনে পড়ে। সময় গড়িয়েছে বহুদূর। সেই কিশোর এখন কত বড় হয়েছে পাঠক নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছেন। আমি অজোপাড়া গাঁয়ের ছেলে। পড়াশুনার খাতিরে জেলা শহরে পর্দাপণ। প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে ক্রিকেট পাগল আমি।

একদিন ক্রিকেট না বুঝেই ভালো বেসেছিলাম। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন অনেক আগেই কবর দিয়েছি। তবে ক্রিকেটকে অন্ধের মতো ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই বাংলাদেশের পরাজয়ে ব্যথিত হই। হারের রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না। অবশ্য ঘুমোতে না পারার সময় টপকে এসেছি। একটু কৌশলী হয়েছি। যখন ঝঞ্জাটমুক্ত জীবন ছিলো তখন বাংলাদেশের খেলার দিন বরাদ্দ রাখতাম।

আগের দিন সবকাজ গুছিয়ে নিতাম। কতো কতো আয়োজন। অথচ দিন শেষে হারের ব্যর্থতা। তিক্ত স্বাদ। তারপরেও আশাহত হইনি। স্বপ্ন দেখেছি; বাংলার ক্রিকেট এগিয়ে যাবে। এগিয়েছেও বহুদূর। এখন বুকে সাহস নিয়ে বলে ফেলি ‘ বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত”।

এক বলে তের রান হতে পারে এমন দিবাস্বপ্ন কেউ দেখে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমি দেখতাম। এগারতম ব্যাটসম্যানও দল জেতাতে পারে এমন বিশ্বাসও বুকে লালন করতাম। মুহাম্মদ রফিকের চার ছক্কায় স্বপ্নবাজ করেছে আমায়। কিংবা মাঝে মাঝে এনামুল হক মনি’র ব্যাটিং সাহস জুগিয়েছে। এরপর কার্ডিপ, কলম্বো, কিংবা কলকাতার ইডেনগার্ডেনে বাংলার দামাল ছেলেদের দাপট দেখেছি। বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারকে আমরা পেয়েছি। কাটার মাস্টার পেয়ে গেছি। গড়নে ছোট হলে মুশির তেঁজ দেখে পুরো বিশ্ব। ভদ্র খুনি মাহমুদুল্লাহ কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। আর রুবেলের ঈগল দৌঁড় দেখে চমকে উঠে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। আর তামিমতো অসাধারণ! অনবদ্ধ! ২০০৭ সালে জহির খানকে উড়িয়ে মারা তামিম ইকবালকে তখনি আন্দাজ করতে পেরেছিলো ক্রিকেট দুনিয়া।

আবার নিজ দেশের মাটিতে এমন বীরদের উপস্থিতিতে হারের পুনরাবৃত্তিও দেখিছি। সিরিজ হাতছাড়া করেছি। হতাশ হইনি। হবোও না। ১৯৯৯ সাল থেকে ছয় সাত বছর হারতে হারতে জয় ভুলে যেতাম। তারপর হঠাৎ একটা জয়। সেকি আনন্দ। কিযে উচ্ছ¡াস! বুঝানো সম্ভব নয়।

ক্রিকেট আমার আবেগ; তাই প্রসঙ্গ ছেড়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি। আর বকবক না করে আসল কথায় ফিরতে চাই। চলতি নিদাহাস সিরিজের প্রথম ম্যাচ বাদে বাংলাদেশের বাকি তিন ম্যাচ নিয়ে আমি ফেসবুকে আগাম স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। শ্রীলংকার সাথে প্রথম ম্যাচে ২১৪ রান টপকে বাংলাদেশ জিতবে। স্ট্যাটাসটি যখন দিয়েছি; তখন বাংলাদেশ দুই ওভার ব্যাটিং করেছে। আমার স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্ট করতে ফেবু বন্ধুরা ভয় পেয়েছিলো। আমাকে পাগল বলতে অনেকেই দ্বিধা করেনি। আগেই বলেছি আমি ক্রিকেট পাগল মানুষ। পাগল উপাধিতে কোনো ক্ষোভ নেই। বাংলাদেশ জিতেলো। আমার ভাবনা সঠিক হলো। তারপর ভারতের ম্যাচে মনে মনে করেছি বাংলাদেশ জিতবে। তেমন স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে লিখেছিলাম ‘বিজয় নিশ্চত’।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অল্প কিছু রানে হেরেছে। অনেকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছি, আমি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করিনি। সুতরাং বাংলাদেশ হারেনি। সর্বশেষ গত শুক্রবারের ম্যাচে শ্রীলংঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ ফাইনালে উঠে। সেদিনও আমি বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের দ্বিতীয় বল দেখেই বলেছিলাম ‘বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত’। সত্যি সত্যি আমার স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়। আমার আগাম তথ্য সত্য হয়ে যায়। অনেকেই আমাকে যোতিষ উপাদি দিয়েছেন। ইনবক্স করেছেন। কথা বলেছেন। তাদের জানতে চাওয়া ছিলো আমি কিভাবে আন্দাজ করি। আমি বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্যেই এ লেখাটি শুরু করি।

র্দীঘ দুইযুগের ক্রিকেট অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছি বাংলাদেশ জিতবে। কারণ বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন আমাদের সবার জানা। আমরা কতটা উন্নতি করেছি; যারা নতুন ক্রিকেট দেখছি তাদের পক্ষে অনুমান করা কঠিন। তবে যারা দুই যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট সম্পর্কে জানেন, তাদের জন্যে আন্দাজ করা সহজ। ফেসবুক বন্ধুদের বলছি, আমি জোতিষ নই। পীর নই।

ক্রিকেটকে আমি চোখহীন মানুষের মতো ভালোবাসি বলেই এভাবে বলতে সাহস করি। বুকে জোর পাই। আমি বিশ্বাস করি; আজ বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে নিদাহাস ট্রফি বাংলার ষোলকোটি মানুষকে উপহার দেবে।

বাংলার বাঘ এখন ছোট থেকে কিশোর, কিশোর থেকে টকবগে যুবক হয়েছে । বাঘ থাবা মারে। হুংকার দেয়। কিন্তু গোপনে গোপনে নাগিনের বিষ তৈরি হয়েছে কেউ জানতো না। বাঘের হুংকারের সাথে দামাল ছেলেরা এখন নাগিনের মতো ফনা তুলে। ছোবল মারে।

আঘাত করে নাচে। এ নাচ অব্যহত থাকবে এমন বিশ্বাস আমার মতো ষোল কোটি মানুষের। এ বিশ্বাস যেন আরো মজবুত হয় এমনটাই প্রত্যাশা। এগিয়ে যাও টাইগার্স।

লেখক- কাদের পলাশ, গণমাধ্যমকর্মী।

Share