প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাচীনতম এক পুরাকীর্তি কদম রসুল দরগাহ শরিফ। শোনা যায়, প্রায় পাঁচশ বছর ধরে পায়ের ছাপ বিশিষ্ট একটি কালো পাথরের খণ্ড সংরক্ষিত রয়েছে দরগাটিতে। স্থানীয়দের মতে, পাথরের গায়ে এ ছাপটি সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ডান পায়ের ছাপ। যে কারণে দরগাহ শরিফের নাম হয়েছে কদম রসুল।
দরগাহ কর্তৃপক্ষ জানায়, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ নবীজীর কদম মুবারকের দর্শন পেতে এখানে ছুটে আসে। প্রত্যেকেই আসে কোনো না কোনো বাসনা নিয়ে। ভক্ত-আশেকানদের পাথরটি স্পর্শ করে মুখমণ্ডল মাসেহ করতে দেখা যায়। বাসনা পূরণের আশায় পাথর ধোয়া পানি কিংবা গোলাপ জল পান করে অনেকেই।
হজরত মুহাম্মদের (সা.) জন্ম হয়েছিল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে, বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে। ধর্মপ্রচার ও মুসলিম জাহানকে সঠিক পথ দেখাতে দেশ-দেশান্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু বঙ্গদেশে, শীতলক্ষ্যার পারে মহানবীর আগমন সম্পর্কে ইতিহাসে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে যুগ যুগ ধরে এমন একটি পাথর সংরক্ষণ এবং তাকে ঘিরে দরগাহ ও সর্বোপরি একটি লোকালয় গড়ে ওঠার ব্যাখ্যা কী!
নারায়ণগঞ্জ শহরের পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপারে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের (সম্রাট শের শাহের আমলে দিল্লি হতে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকান পর্যন্ত তৈরি সড়ক) দক্ষিণে নবীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত কদম রসুল দরগাহ শরিফ। কদম রসুল দরগাহ শরিফে এলেই বোঝা যায়, পাথরটিকে ঘিরে আশপাশের মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই।
দরগার খাদেম মো. লোকমান মিঞা বলেন, যুগ যুগ ধরে রসুলের আশেকান-ভক্তরা নানা বাসনা নিয়ে এখানে আসে। কেউ কোনো মুশকিলের মধ্যে থাকলে দরগায় এসে ইবাদত-বন্দেগি করে। নবীজী (সা.)-এর কদম মুবারকে সালাম করে, জিকির-আজকার করে। বিভিন্ন মকসুদ পূরণের আশায় তারা কদম মুবারক ধোয়া পানি পান করে। আবার কেউ কেউ মানত করে। মুশকিলের সমাধান হয় বলেই পরে তারা আবারো আসে।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পায়ের ছাপ। তবে এর সত্যতা নিয়ে কারো কারো কিঞ্চিৎ পরিমাণ দ্বিধা থাকলেও বিষয়টি প্রকাশ করে না তারা।
কথিত আছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মেরাজের রাতে বোরাকে ওঠার সময় বেশকিছু পাথরে তার পায়ের ছাপ পড়ে। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটি রয়েছে জেরুজালেমে। এছাড়া আরো কিছু পাথর রয়েছে ইস্তাম্বুল, কায়রো এবং দামেস্কতে। বাংলাদেশেও এমন দুটি পাথর রয়েছে। যার একটি রয়েছে চট্টগ্রামে, অপরটি নবীগঞ্জের কদম রসুল দরগায়।
ইতিহাসবেত্তা ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঈসা খাঁর সেনাপতি মাসুম খাঁ কাবুলি একজন আরব বণিকের কাছ থেকে বিশালাকার পায়ে ছাপ বিশিষ্ট এ পাথরটি কিনেছিলেন। এ সময় তিনি এই দরগাটি নির্মাণ করেন। ঢাকার জমিদার গোলাম নবী পরে ১৭৭৭ থেকে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে নবীগঞ্জ এলাকার একটি উঁচু স্থানে একগম্বুজ বিশিষ্ট দরগা নির্মাণ করে সেখানে পাথরটি স্থাপন করেন।
পাথরটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থানীয় এক বৃদ্ধ জানান, তার বাড়ির আঙিনা থেকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দরগার প্রবেশ তোরণ। জীবনে প্রায় প্রতিদিনই কারণে-অকারণে অসংখ্যবার তাকে দরগাহ শরিফে আসতে হয়। কদম রসুল তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, এটা সাধারণ একটা পাথর না। এটা নবীজী (সা.)-এর কদম মোবারক। আমাদের মুরব্বিদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে শুনে আসছি। নবীর কদম মোবারকের প্রতি কিভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হবে তারা আমাদের সে শিক্ষা দিয়ে এসেছেন। আমরাও আমাদের সন্তানদের একই শিক্ষা দিচ্ছি।
তিনি জানান, পায়ের ছাপ বিশিষ্ট এই পাথরটি প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ইতিহাস বহন করে আসছে এবং লাখ লাখ মানুষের কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহ প্রদর্শিত হয়ে আসছে।
কদম রসুল দরগাহ শরিফের সামনে কারুকাজ খচিত একটি সুউচ্চ তোরণ রয়েছে। দেখে মনে হবে যেন কোনো মসজিদ বা মাজার। আসলে এটা দরগাহ শরিফে প্রবেশের মূল ফটক। ২৫টি সিঁড়ি ডিঙিয়ে প্রবেশ করতে হয় দরগাহ শরিফে।
তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বাম দিকে রয়েছে একটি মসজিদ। ডান দিকে রয়েছে ১৭টি পাকা কবর। দরগাহ শরিফের খাদেম জানান, কদম রসুল দরগার প্রতিষ্ঠাতা মাসুম খাঁ কাবুলির বংশধরদের কবর এগুলো।
ঠিক মাঝ বরাবর এক গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট্ট একটি কক্ষ রয়েছে। যেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কদম মুবারকের ছাপ সংবলিত পাথরটি সংরক্ষিত রয়েছে।