বিশেষ সংবাদ

বাংলাদেশী হামিদের মশকনিধন যন্ত্র এখন সারাবিশ্বে আলোড়ন তুলছে

ইচ্ছেশক্তি প্রবল থাকলে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। তেমনি উদ্ভাবনী শক্তি মানুষের জীবনকে করে তোলে আরো সহজ। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর আব্দুল এমনি এক মানুষ, তিনি এই গরমের দেশে ভয়ঙ্কর জীবাণুবাহী পোকা মশা নিধনের এক স্বাস্থ্যসম্মত কার্যকরী যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন।

উপজেলার পোপাদিয়ার আবদুল হাকিম মেম্বারের বাড়ির সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হাজি শামসুল হক ও মাহমুদা খাতুনের সন্তান এম. এ. হামিদ। ১৯৯৮ সালে হাওলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। ২০০০ সালে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, ২০০৩ সালে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিযোগাযোগ বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন। এছাড়া জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রিও নেন হামিদ।

তার উদ্ভাবিত নতুন মশকনিধন যন্ত্রটি গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ গেজেটে বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। নতুন এই যন্ত্রের তিনি নাম দিয়েছেন ‘এইচইসি মসকিটো কিলার’ (হামিদ ইলেকট্টো-কেমিক্যাল মসকিটো কিলার)।

এ প্রসঙ্গে হামিদ বলেন, ২০১১ সাল থেকে তিনি গবেষণা শুরু করেন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে একপর্যায়ে সফল হয়েছেন। ওই বছরের ২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট বিভাগে আবেদন করেন তিনি। ২৪ জুন আবেদন গ্রহণ করা হয়। তার পেটেন্ট নম্বর ১৫০/২০১৪।

ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতি অনেক রোগেরই বাহক মশা। এই মশা নিধনে তরল ওষুধ, কয়েল, বৈদ্যুতিক জালসহ নানা উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কয়েলে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে উদ্বেগ রয়েছে। অন্য উপকরণগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও ভোক্তাদের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ। হামিদ তার উদ্ভাবিত নতুন যন্ত্রটিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে দাবি করছেন।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে হামিদের ইলেকট্টো-কেমিক্যাল মশকনিধন যন্ত্রটি উদ্ভাবনের কথা। সাম্প্রতিক সময়ে জিকা ভাইরাসের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতার কথা জানিয়ে হামিদ বলেন, ‘ইতিমধ্যে মশা নিধনে ইলেকট্রনিক, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ও রাসায়নিক যেসব উপকরণ-যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করা হয়েছে তার থেকেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে আমার উদ্ভাবিত ইলেকট্রো-কেমিক্যাল মসকিটো কিলার।’

তিনি জানান, সরকার তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটির স্বীকৃতি দেয়ার আগে প্রায় ১৮ মাস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খোঁজখবর নিয়েছে। কোথাও এমন কোনো যন্ত্র নেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তারপরই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

৩৪ বছর বয়সী হামিদ বলেন, মশা নিধনের এ যন্ত্র এবং ব্যবহৃত রাসায়নিক থেকে কোনো বিষক্রিয়া হয় না, বরং যন্ত্রটি মশাকে আকৃষ্ট করবে। যন্ত্রটির মধ্যে যে রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়েছে তা এক ধরনের খাদ্য। মানুষের উপস্থিতি টের পেলে যেভাবে মশা আকৃষ্ট হয় ঠিক সেভাবে মানুষ মনে করে ওই খাদ্যটির সংস্পর্শে চলে আসবে মশা। এক ফুট উচ্চতা এবং ছয় ইঞ্চি প্রশস্ত (টেবিল ল্যাম্প আকৃতি) যন্ত্রটিতে পাঁচ ওয়াটের একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব থাকবে। যন্ত্রটি চালু করলে লাগিয়ে দিলে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে মশা নিধন শুরু হয়ে যাবে। দুই হাজার বর্গফুটের মধ্যে যত মশা থাকবে সব মশা যন্ত্রের ভেতর ঢুকে যাবে। যন্ত্রটি মানবদেহের মতো মশাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এ যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। বিদ্যুৎ ছাড়াও ব্যাটারি দিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা চলবে।

যন্ত্রটির ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম। বিদ্যুৎ খরচ হবে সাত ওয়াট। একটি রিফিল দিয়ে (রাসায়নিক দ্রব্য) চার মাস চলবে। এর মূল্য ১০০ টাকা। একটি রিফিলসহ যন্ত্রটির এককালীন মূল্য দুই হাজার টাকা। চার মাস পর পর রিফিল পরিবর্তন করতে হবে।

হামিদ বলেন, এ যন্ত্রটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থমুক্ত, বিষাক্ত ধোঁয়াহীন, শব্দহীন, কয়েল ও স্প্রের মতো বায়ুদূষণ করে না, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব, ডিম লাইটের মতো জ্বলে, সহজে বহনযোগ্য, বিদ্যুৎসাশ্রয়ী, স্থায়ীভাবে মশা নিধন করে। যন্ত্রটির রয়েছে এক বছরের ওয়ারেন্টি।

হামিদ জানান, এর মধ্যে চীনে গিয়ে ওই দেশের সরকারের কাছে তার পেটেন্ট জমা দিয়েছেন। সেখানে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য হার্মেস সান করপোরেশন লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন গত বছরের ১৫ মে। এরপর ভারত সরকারের কাছেও আবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

নিজ উদ্ভাবিত যন্ত্র ব্যবহার করে মশকনিধন বিষয়ে ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে হামিদ ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন বলে জানান। এইসব দেশেই জিকা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব দেখা দিয়েছেন। হামিদ বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করব। আমার বিশ্বাস এইচইসি মসকিটো কিলার দিয়ে জিকা ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিধন হবে।’

এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের পরীক্ষক (পেটেন্ট) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘উনি (হামিদ) যন্ত্রটি আবিষ্কারের কথা জানিয়ে আমাদের কাছে আবেদন করেছিলেন। এরপর আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, মশকনিধনের অত্যাধুনিক এ যন্ত্র বিশ্বের অন্য কোথাও নেই।’

অর্থের অভাবে নতুন এই যন্ত্র বাজারজাত করতে পারছেন না জানিয়ে হামিদ বলেন, ‘আমি গবেষণা করে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছি। কিন্তু আমার পক্ষে বাজারজাত করা সম্ভব নয়। এটি প্রচার না হওয়ায় কেউ এগিয়ে আসছে না। তবে কিছুদিন আমি স্বল্প পরিসরে কিছু যন্ত্র এলাকার আশপাশের মসজিদ ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সরবরাহ করি।’ এর মধ্যে যন্ত্রটির চাহিদা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।

সরকারিভাবে সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সরকার প্রতিবছর শত শত পেটেন্ট দেয়। এগুলো প্রচার করতে গেলে অনেক টাকা খরচ হবে। আমরা উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিই। এটি বাজারজাতকরণের বিষয়টি আমাদের আওতাধীন নয়।’

লেখক : এম. ইউছুপ রেজা, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

সূত্র : বাংলামেইল

||আপডেট: ০৮:০৬ অপরাহ্ন, ১৮ মার্চ ২০১৬, শুক্রবার

এমআরআর

Share