আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের বিজয় উল্লাস দেখে ক্রিকেটের অন্ধ প্রেমে পড়ে যান এক তরুণ। সেই থেকে স্বপ্ন, হতে হবে আকরাম খানের মতো ক্রিকেটার। কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে বয়সে হাতে ব্যাট-বল তুলে নেওয়া উচিত ছিল, সেটা বহু আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হাল ছাড়েননি, ঠিকই সাফল্য ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। তবে ক্রিকেট নয়, ফুটবলের রেফারি হিসেবে!
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন, ক্রিকেটেই। ক্রিকেটার হিসেবে এগিয়েও গিয়েছিলেন কিছু দূর, কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। নিজের সামর্থ্য বুঝতে পেরে বিকেএসপিতে থাকা অবস্থাতেই জোর দিলেন কোচিং ও ক্রীড়াবিজ্ঞানের পড়াশোনায়। এভাবেই বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে জার্মানি, সেখান থেকে ইতালিতে পা রাখা। ইতালির ফুটবলে বনে গেলেন রেফারি।
প্রায় এক যুগে বাংলাদেশি এক ক্রিকেটার কীভাবে ফুটবলের রেফারি বনে গেলেন, তাও আবার চারবারের বিশ্বকাপজয়ী একটি দেশে? হাতে নিয়ে নিন পপকর্নের প্যাকেট, হলিউডি কোনো সিনেমার ক্রিপ্ট অপেক্ষা করছে সবার জন্য!
গোপালগঞ্জের ছেলে রিপন বিশ্বাস। বিকেএসপিতে ক্রীড়াবিজ্ঞান ও ক্রিকেটে ‘এ’ লেভেল কোচিং কোর্স করে ২০০৬ সালে পা রাখেন জার্মানিতে। ফুটবলের দেশে গেলে কী হবে, তাঁর প্রতিটি শিরা তো চিৎকার করে শোনাচ্ছে ক্রিকেটের স্লোগান। ভারতীয় জামান সাঈদের সহযোগিতায় বার্লিনে গঠন করেন ক্রিকেট সংস্থা। পরে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় জার্মানির ক্রিকেট সভাপতির সঙ্গে। কিন্তু জার্মানিতে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার তেমন সুযোগ নেই বলে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতালিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে পা রাখলেন রোমে। ঐতিহাসিক রোমান সাম্রাজ্যে বসতি গড়ে বদলে ফেললেন জীবনের গল্পটাই।
ফ্রান্সেসকো টট্টির শহরে গড়ে তুললেন পিয়াসা ভিতোরিয়ো নামে ক্রিকেট ক্লাব। ‘শেষ রোমান সম্রাট’ টট্টির শহরে ব্যাট-বলের খেলা! ভাবা যায়? ছোট ক্রিকেট অঙ্গনে সাফল্যও ধরা দিতে লাগল তাঁর হাতে। কোচিংয়ে ‘এ’ লেভেল থাকায় ইতালিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের অধীনে অলিখিত কোচিং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করলেন। ‘এ’ লেভেল সার্টিফিকেট তো ইতালির জন্য অনেক কিছু। গল্পটা ‘ইতালির বুকে বাংলাদেশি ক্রিকেট বিপ্লব’—এই শিরোনামেই শেষ হতে পারত। কিন্তু ওই যে জীবনটা নাটকীয়তায় ভরা।
ক্রিকেট নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি জাগালেও কিছুতেই ভালো কিছু হচ্ছিল না। ইতালিয়ান ক্রিকেট বোর্ড থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল না সহায়তা। উল্টো যে মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন হয়, সেই মাঠে সারা দিন ফুটবলের ভিড়। সঙ্গে ব্যাট-বলের দিকে মানুষের অবাক দৃষ্টি তো আছেই। একদিন এক নাইজেরিয়ান বলে বসলেন, এগুলো বাদ দিয়ে পারলে ফুটবলে কিছু করো। বাঙালি মানেই তো ফুটবলের সঙ্গে ভালোবাসা। ফিটনেস ভালো থাকায় রেফারিং কোর্সে নাম লেখালেন রিপন, ‘আমার পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ ছিল না। চিন্তা করে দেখলাম, বিকেএসপিতে তো কতই ফুটবল খেলেছি। আর ফিটনেস তো ভালোই আছে। তাই রেফারিংয়ে যোগ দিলাম।’
রেফারিং কোর্সে দলের মধ্যে একমাত্র বিদেশি হওয়ায় সবার নজর কেড়েছিলেন অতি সহজেই। সেখানে টেকনিক্যাল হেড হিসেবে পেলেন অনেকের চোখেই ইতিহাসের সেরা রেফারি পিয়েরলুইগি কলিনাকে। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালের দায়িত্ব পালনকারী কলিনার সংস্পর্শ রিপনকে রেফারিংয়ের প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলল। ধাপে ধাপে পেরিয়ে ম্যাচ চালানোর দায়িত্ব পেতে শুরু করলেন লাৎসিওর আঞ্চলিক বয়সভিত্তিক ম্যাচগুলোর। ম্যাচপ্রতি আয় হতো ৭০ থেকে ৮০ ইউরো। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে রোম ডার্বির ম্যাচও পরিচালনা করেছেন।
এরই মধ্যে সুযোগ পেয়ে যান ক্রীড়াবিজ্ঞানের ওপরে ইউরোপিয়ান মাস্টার্স কোর্সে পড়াশোনা করার। ইতালিতে অবস্থান করার বৈধ কাগজও চলে আসে হাতে। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে পুরোনো শত্রু ইনজুরির কাছে হার মেনে যেতে হয় শল্যচিকিৎসকের টেবিলে। সেখান থেকে ফিরেছেন মাঠেও। তবে ফুটসালে। এখন মিলানে ফুটসাল রেফারি হিসেবে তাঁর বেশ কদর, হয়েছেন ইনস্ট্রাক্টর। ব্যক্তিগত মালিকানায় একটা ফিটনেস ক্লাবও আছে। প্রায় এক যুগের পরিক্রমায় ইতালিতে ফুটবল নিয়ে বেশ আছেন বাংলাদেশের ছেলে, ‘অনেক সম্মান পেয়েছি। ফুটবল ফেডারেশন থেকে আমাকে একটা কার্ড দেওয়া হয়েছে। ইতালিতে যেকোনো ফুটবল ম্যাচে ভিআইপি মর্যাদায় খেলা দেখতে পারি। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।’ হাজার মাইল দূর থেকেও ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে টের পাওয়া গেল রিপনের উচ্ছ্বাস।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ২০ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার
এএস