‘বল বীর-বল উন্নত মম শির!- বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ

কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার লাইন। এ বছরের ডিসেম্বরে নজরুলের দেশকাঁপানো এ বিদ্রোহী কবিতা রচনার শতবর্ষ পূর্ণ হবে। কয়েক দিন আগে ১২ ভাদ্র (শনিবার, ২৮ আগস্ট) আমরা কবি নজরুলের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছি।

এর আগে গত ১১ জ্যৈষ্ঠ আমরা উদযাপন করেছি কবির ১২২তম জন্মজয়ন্তী। কয়েক মাস পরই হবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষপূর্তি উৎসব। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে পৃথিবীজুড়েই নজরুলপ্রেমীরা নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন। বিদ্রোহী কবিতা ৩৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি এবার ভারতীয় উপমহাদেশের ১০০টি ভাষায় অনুবাদের আয়োজন চলছে। শতবর্ষ উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট ‘বিদ্রোহী’ নামে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করছে।

বাংলা একাডেমিও ‘বিদ্রোহী’ নামে স্মারকগ্রন্থ করার উদ্যোগ নিয়েছে। একই সাথে বাংলা একাডেমি তার নজরুল মঞ্চের চার পাশের দেয়ালে বিদ্রোহী কবিতাটি ম্যুরাল আকারে স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে। পুরো কবিতাটিকে আট থেকে দশটি ভাগে ভাগ করে ‘টেরাকোটা’য় এ ম্যুরাল তৈরি হবে। এরই মধ্যে সৃজনশীল শিল্পীদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করা হয়েছে বলে একাডেমি থেকে জানা যায়।

বিদ্রোহী কবিতা রচনার এক শ’বছরের পাশাপাশি এ বছরটি কবি নজরুলের কুমিল্লা আগমনেরও শতবর্ষ। কবির জীবন ও সৃষ্টিতে কুমিল্লা এক বিশেষ অধ্যায়। ‘দু’ভুবনের দু’ নারী’ নার্গিস ও প্রমীলার সাথে কবির সংশ্লিষ্টতার এক অসাধারণ কাহিনীও আছে কুমিল্লাকে ঘিরে।

নার্গিসের সাথে ১৯২১ সালের ১৮ জুন নজরুলের পরিচয় ও বিয়ে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিয়ের রাতেই নজরুল নার্গিসের দৌলতপুরের বাড়ি (মুরাদনগর) ত্যাগ করেন। নজরুল-নার্গিস বিয়ের বিষয়টি রহস্যাবৃত থেকে যায়। নার্গিসের বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নজরুল প্রমীলাদের বাড়িতে একপক্ষকাল অবস্থান করে কলকাতায় ফিরে যান।

নার্গিসের সাথে ঘর না বাঁধলেও নার্গিসই ছিলেন তার প্রথম প্রেম।। ‘নার্গিস’ নামটিও নজরুলের দেয়া। দৌলতপুর মুন্সীবাড়ির পুকুর পাড়ে এক সকালে তাকে দেখে নজরুল জানতে চাইলেন নাম। মেয়েটি নাম বলল সৈয়দা খাতুন। এত সুন্দর চেহারায় এ নাম মানায় না। নজরুল নাম দিলেন নার্গিস। পারস্য দেশের লতাপাতার ফুলের নাম এটি। সে দেশে আমার এক প্রিয় কবি আছেন, হাফিজ। তার কবিতায় এ ফুলের নাম আছে। কিন্তু বিয়ের পর তাদের বিচ্ছেদ নজরুলের মনে গভীর ক্ষত ও স্থায়ী বেদনার সৃষ্টি করেছিল।

নজরুলের বহু গান ও কবিতায় নজরুল-নার্গিস প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। ষোলো বছর পর কলকাতায় একবার তাদের দেখা হয়েছিল। আবেগে দু’জনই তেমন কথা বলতে পারেননি। নজরুল শুধু বললেন, নার্গিস বাড়ি চলে যাও। প্রমীলা ও তার মা তোমাকে ভালোভাবে নেবে না।

তবে নার্গিস ও প্রমীলা লেখার বিষয় নয়। শতবর্ষী একটি কবিতাই এ আলোচনার বিষয়। কাজী নজরুল ইসলাম এক শ’ বছর আগে, ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতার মৌলালি অঞ্চলের কাছে ৩/৪ সি,তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে পেনসিলে রচনা করেন কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত কাজী নজরুল ইসলামের বয়স তখন মাত্র ২২ বছর আট মাস। বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিদ্রোহী কবিতা রবীন্দ্র যুগের সাহিত্য থেকে বেরিয়ে নতুন এক সাহিত্য ধারার সূচনা করে।

বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতা ছিলেন নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদ। নজরুল ভোরেই তাকে কবিতাটি শুনিয়েছিলেন। কমরেড মুজাফফর আহমদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন,“আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।”

তিনি আরো লিখেছেন, ‘তখন নজরুল ও আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের অর্থাৎ বাড়ির নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে। রাতের কোন সময় তা জানি না। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটা কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটিই সে আমাকে পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাতে কবিতাটি লিখেছিল।

তা না হলে এত সকালে সে আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।… এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুল কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সাথে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেনসিলে লিখেছিল।’

সেদিন ওই বাড়িতে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হকও আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান নজরুল। তিনি সেটি শুনে একটি কপি সাথে নিয়ে যান। মুজাফফর আহমদ উল্লেখ করেন, “আমি বাইরে গিয়ে ১২টায় ফিরে এলে নজরুল জানায়, অবিনাশ দা এসেছিলেন।

তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার ঠিক নেই, কপি করে দাও, ‘বিজলী’তে ছেপে দেই আগে।” তাকেও নজরুল সেই পেনসিলে লিখেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিলেন। ১৩৯ পঙ্ক্তির এ কবিতা ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়।

অবিরাম বৃষ্টির দিনেও পত্রিকার চাহিদা এত হয়েছিল যে,বিজলী দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। পরে মুসলিম ভারতে ফাল্গুন মাসে আবার ছাপা হয়। বিজলী সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র নজরুলের মুখে শুনে লিখেছেন,বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে নজরুল এটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পর তিনি সানন্দে নজরুলকে বুকে চেপে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন।

নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে বলেন,‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন,তুরস্কের কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভ‚মি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।’

‘তাই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হই হই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’ রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমেই এর সূচনা। তার মতে, “গত একশ বছরে বহু আন্দোলন-সংগ্রামে কবিতাটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কেবল ‘বিদ্রোহী’র জন্য হলেও নজরুল যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ইংরেজি সাহিত্যে টিএস এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এ কবিতা ইংরেজি কবিতার ধারা বদলে দেয়। আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বদলে দেয় বাংলা সাহিত্যের ধারা। বাংলা সাহিত্যে ‘আধুনিক কবিতা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তার পেছনে রয়েছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।

নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল অ্যালবাম ১৯৯৪-এর ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বিষয়ক দীর্ঘ লেখায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে লিখেছেন, ১৯২১ সালের জুন মাসে কুমিল্লার দৌলতপুরে নার্গিসের সাথে বিয়ে নিয়ে দুঃখজনক ঘটনার পর নজরুল ১৭ দিন কুমিল্লায় ছিলেন।

এ সময় ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত ছিল। নজরুল ব্রিটিশবিরোধী সভা, সমাবেশে যোগ দিয়ে গাইলেন, সদ্য রচিত ও নিজের সুর করা স্বদেশী গান, ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা-র আঙিনায়।’ আজি রক্তনিশি ভোরে, একি, শুনি ওরে, মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খল ইত্যাদি গান।

১৯২১ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে নজরুল আবার কুমিল্লায় আসেন। অসহযোগ মিছিলে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও। ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’

কলকাতায় ফিরে গিয়েই রচনা করেন তার ঐতিহাসিক ‘ভাঙার গান’- কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ ও বিদ্রোহী কবিতা- ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির।’ বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই।

বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ১২টি কবিতার একটি। ‘বিদ্রোহী’ এ কাব্যের দুই নম্বর কবিতা। ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সাথে সাথে নজরুলের খ্যাতি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তার নাম হয়ে যায়। কবিতাটি হয়ে ওঠে নজরুলের কাব্যমূর্তির প্রতীক।

সেনাবাহিনীর চাকরি শেষ করে কলকাতায় ফিরে নজরুল সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, যারা সব কিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং শৃঙ্খল পরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো।

বিশিষ্ট গবেষক মোরশেদ শফিউল তার ‘নজরুল জীবন কথা’ বইয়ে নতুন একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, নজরুলের জন্মগ্রাম চুরুলিয়ার কাছে সাঁওতাল পরগনার বিদ্রোহী পরিবেশও বিদ্রোহী নজরুলের প্রাথমিক চেতনাভ‚মি হিসেবে কাজ করেছে। নজরুলের জন্মের দশ বছর আগেই এ অঞ্চলে ঘটে ‘মুন্ডা বিদ্রোহ’। এসব বিদ্রোহের গল্প ও গান চুরুলিয়া ও আশপাশে বেশি বয়সী মানুষের মুখে মুখে ফিরত। নজরুল ছোটবেলায় এসব লড়াই-সংগ্রামের গল্প শুনেছেন। তার মনন গঠনে এটি কমবেশি প্রভাব ফেলেছিল।

কবি আল মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে নজরুল সম্পর্কে বলেছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম অসাধারণ কবিপ্রতিভা। তার বিদ্রোহী কবিতার মতো এমন কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তাই তো কবি শামসুর রাহমান তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় লিখেন, স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক,জাতীয় প্রেস ক্লাব ।
এজি

Share