সময় আর আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে যেয়ে বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমেও ব্যাপক গতির সঞ্চার হয়েছে। আমাদের দেশে এক সময় গণমাধ্যম সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মধ্যে।
সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের (রেডিও বাংলাদেশ) কার্যক্রম ছিল বিনোদননির্ভর আর সংবাদ ছিল সরকারি প্রচার-প্রচারণায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তির নবদিগন্ত উন্মেচিত হয়ে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমাদের দেশে গণমাধ্যম অবিশ্বাস} গতি পেয়েছে।
কাগজের দৈনিকের পাশাপাশি এখন অনলাইন নিউজ পোর্টাল (পত্রিকা), বিপুল সংখ্যক বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিও নিয়ে গণমাধ্যমের বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। জেলা ও উপজেলা শহর থেকে দৈনিক/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
এছাড়া ফেইসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও আজকাল গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সবমিলিয়ে হঠাৎ বদলে যাওয়া গণমাধ্যম নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে মফস্বলে এই চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। চাঁদপুর জেলায় বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতায় সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও অনেক। এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে তা যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে হবে আমাদেরকেই। তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরছি।
১. ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে কাগজে ছাপা পত্রিকার পাঠক ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংবাদপত্র মালিক ও সাংবাদিকদের করণীয় রীতিমতো গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিৎ।
২. অনলাইন পত্রিকার পাঠক সৃষ্টি হলেও এর মাধ্যমে সাংবাদিকের আয়ের কোনো সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। অথচ এই মাধ্যমকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট সেবাদানকারী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো ইউজারদের কাছ থেকে ঠিক’ই বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ডাটা বিক্রির মাধ্যমে। এছাড়া অনলাইন পত্রিকার বিজ্ঞাপনের বাজারও এখন পর্যন্ত অনেক মন্দা। যদিও ছাপা কাগজের তুলনায় অনলাইন পত্রিকার পরিচালন ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম।
৩. ইন্টারনেটের কল্যাণে অনলাইন নিউজ পোর্টাল/পত্রিকার ব্যাপক প্রসার একদিকে যেমন স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে একই সাথে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আসায় যে কেউ যখন-তখন একটি ওয়েবসাইট খুলেই অনলাইন পত্রিকা চালু করে দিচ্ছেন। শুরুর দিকে বিষয়টি স্বাধীন সাংবাদিকতার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখলেও এখন এটি সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
কোনো ধরনের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কিংবা কোনো নীতিমালা মান্যতার বাধ্যবাধকতা না থাকায় কিছু কিছু অনলাইন পত্রিকা এখন অপপ্রচারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে সাংবাদিকদের প্রতি গণমানুষের বিশ্বাস ও আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যা প্রকৃত গণমাধ্যম ও পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এখন যে কেউ চাইলেই একটি অনলাইন পত্রিকা খুলে বসতে পারেন, যা খুশি তা লিখতে পারেন। এমন স্বেচ্ছাচারিতার অবারিত সুযোগ স্বাধীনতার সীমাকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে ইতোমধ্যে। অপপ্রচার রোধে অতিসম্প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাশ হলেও এসব অনলাইন পত্রিকা নিয়ন্ত্রণে এখনো কার্যকরী পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অথচ এটি সবার আগে করা জরুরি। তাছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারাও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
৪. মহাকাশের স্যাটেলাইট সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশে এখন বহু টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে। প্রায় সব চ্যানেলেই সংবাদ থাকছে। কিছু চ্যানেল সার্বক্ষণিক সংবাদভিত্তিক। এসব টেলিভিশন চ্যানেলে জেলা পর্যায়ে সংবাদ প্রতিনিধিও থাকছে। এ জন্য জেলা পর্যায়ে প্রচুর টেলিভিশন সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হলেও প্রধান কার্যালয়ের তুলনায় প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময়, যন্ত্রপাতি, পরিবহন ইত্যাদি অতিপ্রয়োজনীয় কোনো সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ দ্রæত ও পূর্ণাঙ্গ সংবাদ/ফুটেজ প্রেরণে এসব জেলা প্রতিনিধির কাছ থেকেই ঢাকার স্টাফ রিপোর্টারদের মতো সমান তথ্যসেবা দাবি করে অফিসগুলো। কিন্তু বেতন-ভাতা দূরে থাক, সংবাদ প্রতিনিধিকে সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনীয় খরচটুকুও দিচ্ছে না অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় এটি একটি বড় অন্তরায়।
৫. দেশে অনেক জাতীয় ও আঞ্চলিক রেডিও স্টেশন চালু থাকলেও এগুলো সেভাবে ¯্তা সৃষ্টি করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে রেডিও’র প্রচলন উঠে যাওয়া এবং বিকল্প সহজলভ্য যন্ত্র হিসেবে মোবাইল ফোন থাকলেও কেউ তা ব্যবহার করছে না।
৬. সবার আগে দ্রæত সংবাদ প্রেরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বর্তমান সময়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘটনার সাথে সাথে তথ্য ও ফুটেজ চায়। বিশাল আয়তনের একটি জেলায় ঢাল-তলোয়ারবিহীন একজন প্রতিনিধির পক্ষে সারা জেলার ঘটনা-দুর্ঘনার তথ্য/ফুটেজ সবার আগে প্রেরণ করা অনেক কঠিন। টেলিভিশন স্ক্রল/টিকারে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই প্রতিযোগিতার কারণে প্রায়’ই ভুল তথ্য পরিবেশিত হয় সংশোধনের অত্যন্ত সীমিত সুযোগ থাকা টেলিভিশন মিডিয়ায়।
৭. সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের আয়ের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল জেলা-উপজেলা পর্যাযে কর্মরত সাংবাদিকদের যে সামান্যতম সম্মানী/বিল প্রদান করে থাকেন তা মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় সাংবাদিকদের মোবাইল-ইন্টারনেটের খরচ মাত্র। তাও সব প্রতিষ্ঠান প্রদান করে না। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের বাজারও দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে সাংবাদিকদের বৈধ আয় তথা আর্থিক নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে। যা স্বাধীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও জনপ্রত্যাশিত সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। জেলা-উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বৈধ ও গ্রহণযোগ্য উপায়ে আয়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার জরুরী হয়ে পড়েছে।
৮. সরকারের মুক্ত গণমাধ্যম নীতির সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার শেল্টার ও রাজনীতিকরা তাদের বহুল প্রচারের স্বার্থে একে একে বহু গণমাধ্যম খুলে বসেছেন। গণমাধ্যমের এই সংখ্যাধিক্যের অনিবার্য প্রয়োজনে জেলা-উপজেলায় সাংবাদিকের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই সুযোগে অশিক্ষিত, অযোগ্য অনেকে খুব সহজে সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন। এর বাইরে সরকার/কর্তৃপক্ষের অনুমোদনবিহীন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীর সংখ্যাও কম নয়। সব মিলিয়ে ব্যাপক সংখ্যক গণমাধ্যম এবং বেশুমার গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতি এই শিল্পের ভাবমূর্তি, মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
৯. ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার সুবাদে ফেইসবুক ও এ জাতীয় আন্তর্জাতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে আমাদের দেশে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা, অসত্য, অর্ধসত্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অস্তিত্বহীন ভুয়া তথ্য ফেইসবুকের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আবার অনুমোদিত ও অনুনোমোদিত অনলাইনের সংবাদ ফেইসবুকে ট্যাগ, শেয়ার, লাইক, কমেন্ট প্রভৃতি করে মূল ধারার গণমাধ্যমকে বিতর্কিত করে তুলছেন। ফেইসবুক গণমাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত না হলেও অনেকেই একে গণমাধ্যম হিসেবে অপব্যবহার করায় গণমাধ্যম সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এখন সর্বাধিক জরুরী।
১০. আগেই বলেছি, নানা ধরনের বৈধ-অবৈধ গণমাধ্যম সৃষ্টির সুবাদে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এখন গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যাও বিপুল। নানা মত ও পথের এই বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যমকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। পেশাগত এই অনৈক্য ও বিরুদ্ধাচারণ সাংবাদিকতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এই অনৈক্যের কারণ যেমন বহুবিধ এর সমাধানও ভিন্নতর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা জটিল ও কঠিন।
এর বাইরেও বহু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও সমাধান সূত্র চিহ্নিত করে ঐক্যবদ্ধ সমাধান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে সবার আগে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এরপর সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। প্রথমে সর্বাধিক জরুরী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে এরপর ধীরে ধীরে অন্য চালেঞ্জ/সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে।
এই মুহূর্তে অনুমোদনবিহীন মিডিয়া বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ, কর্মরত সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সাংবাদিকতা পেশার আর্থিক নিরাপত্তা তৈরীর উপায় খুঁজে বের করা সবচেয়ে জরুরী। একই সাথে অযোগ্য, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা এবং নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত খারাপ লোকদের এই পেশায় নতুনভাবে অন্তর্ভুক্তি রোধ করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট/অনলাইনের অপপ্রয়োগ রুখতে গণমাধ্যমকর্মীদেরও এ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকদের সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই।
সোমবার (১ অক্টেবার) চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাংবাদিক সমাবেশের মূল প্রবন্ধ ছিল এই লেখাটি