করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্দিনে বাংলাদেশও আজ কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। স্বল্পমেয়াদি হলে এই পরিস্থিতিটি শুধু আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যেরই ক্ষতি করত। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতি ও মানসিক স্বাস্থ্যও আজ বিপদগ্রস্ত। বিশেষ করে খুব নাজুক অবস্থায় পড়েছে শিশুরা। আরো যদি ভেঙে বলি তাহলে বলতে হয় শহরের শিশুরা। এই লেখাটি তাই সেই অভিভাবকদের জন্য, যাঁদের সন্তানরা সদ্য স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে কিংবা স্কুলে যাওয়ার পূর্ববর্তী অবস্থায় রয়েছে।
শিশুরা অত্যন্ত কৌতূহলী হয়। তাদের মধ্যে উদ্দীপনা ও অনুভূতিশীলতা প্রবল মাত্রায় কাজ করে। সমবয়সী এবং নিজের চেয়ে সামান্য বেশি বয়স্ক শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করতে সে আনন্দ পায়। খেলার মাধ্যমে সে শিখে নেয় জীবনে চলার পথের অনেক রকম কার্যকর শিক্ষা, যেটাকে বলে ‘প্লে গ্রাউন্ড লার্নিং’। কিন্তু শহরে শিশুদের সেই সুযোগ সীমিত। শহরের পরিবারগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একক, আশপাশের বাসার শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করার চর্চাটিও শহরে খুব কম। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাশের ফ্ল্যাটের মানুষের নাম পর্যন্ত জানে না কেউ। ফলে স্কুল-পূর্ববর্তী সময়ে শিশু খেলার সাথি পায় খুব কম ক্ষেত্রেই। শিশু যখন স্কুলে নতুন নতুন যাওয়া শুরু করে, সেখানেই কেবল তারা কিছু বন্ধু পায় খেলাধুলা করার জন্য। এদিকে মা-বাবারা ছুটির দিনে হয়তো বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান সন্তানকে। পার্ক, রেস্টুরেন্ট এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোনো আত্মীয়ের বাসায়। এই হলো বেশির ভাগ শহুরে শিশুর বহির্জগত্।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সবাই ঘরবন্দি হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিশুদের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, এবং বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটি বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অভিভাবকদের উচিত এই সময়ে সন্তানের দিকে একটু বাড়তি নজর দেওয়া। কারণ হয়তো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাবে, কিন্তু শিশুদের জন্য উপযুক্ত বাইরের পরিবেশ তৈরি হতে এখনো খানিকটা সময় লাগবে। তাই মা-বাবাদের দায়িত্ব এই সময়ে একটু আলাদা করে শিশুর বিকাশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। এ ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে মানসিক বিকাশের দিকেও।
বলা হয়ে থাকে, এক থেকে ছয় বছর পর্যন্ত শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ হয় সবচেয়ে বেশি। শিশুদের কৌতূহল প্রবল। এই কৌতূহল তাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখতে সাহায্য করে। তাই দামি খেলনা নয়, বরং খেলনার বৈচিত্র্যই শিশুর জন্য কৌতূহলোদ্দীপক ও আনন্দদায়ক। খেলনা আপনি যত দামিই কিনে দিন না কেন, কিছুদিনের মধ্যেই শিশু তার প্রতি আগ্রহ হারাবে। বরং রান্নাঘরের ঢাকনা, পাতিল কিংবা ঘরের ছোট ছোট জিনিস একটি-দুটি করে তার কাছে দিন। তাতে শিশুর কৌতূহলের খোরাকও জুটবে এবং আপনারও দামি খেলনা কিনে দিতে হবে না। এই সময়ে ঘরের সামগ্রী ব্যবহার করে নতুন নতুন খেলা সৃষ্টিতে শিশুকে উত্সাহিত করতে পারেন। কোনো আইডিয়া মাথায় না এলে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে পারেন। গুগল সার্চ করে কিংবা ইউটিউবেও অনেক রকম ঘরোয়া খেলার বুদ্ধি পেয়ে যাবেন, যেখানে সহজ উপায়ে শিশুর নানা দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ পাবেন।
যেহেতু বাইরে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়, তাই সুযোগ থাকলে ছোট সন্তানকে ছাদে নিয়ে যান। তাতে ঘরের ভেতরে আটকে থাকার দমবন্ধ ভাবটি কমে যাবে। সকালের সহনীয় রোদ তার ভিটামিন ‘ডি’র চাহিদা পূরণ করবে, আবার শিশু মুক্ত বাতাসে থাকার সুযোগও পাবে।
সব খারাপের মধ্যেও কখনো কখনো কিছু ভালো দিক থাকে। এ সময় আপনি আপনার সন্তানকে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি সময় দিতে সক্ষম। এটিকে কাজে লাগিয়ে শিশুকে সময় দিন। যদি সে স্কুলগামী হয়, তাকে পড়ান, খেলুন তার সঙ্গে। এতে আপনার সঙ্গে সন্তানের বন্ধন দৃঢ় হবে। শৈশবই শিশুর অনুভূতিশীলতা, সহমর্মিতা গড়ে তোলার উত্কৃষ্ট সময়। এই সময়ের বিপদগ্রস্ত মানুষের কষ্টগুলোর কথা শোনান। পুরোপুরি না বুঝলেও তার ভেতরে ঠিকই বিষয়গুলো কাজ করবে। তাকে নিয়মিত সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার কলাকৌশল রপ্ত করানোরও উপযুক্ত সময় এখন। কারণ হলো, শিশুরা অভিজ্ঞতা থেকেই সবচেয়ে বেশি শেখে। করোনাভাইরাসের কথা এখন শিশুরাও কিছুটা হলেও জানে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে—এ বিষয়টিও অনেক শিশু বুঝতে পারে। তাদের এই জানাটিকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলার অভ্যাস রপ্ত করাতে পারেন।
এই যুগের একটি সর্বগ্রাসী নেশা আছে, যাতে বড়রা তো বটেই, শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আর সেটি হলো ইন্টারনেট আসক্তি। মোবাইল ও টিভিতে দিনের একটি বড় অংশ কার্টুন দেখার ফলে শিশুর কথা বলতে দেরি হওয়া, চোখের সমস্যা, সামাজিকীকরণের সমস্যাসহ আরো নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এই সময়ে যখন শিশুর বাইরে যাওয়ার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ, তখন এই নেশার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা বেশি। সে ক্ষেত্রে মা-বাবারা কার্টুন দেখার সময়টি বেঁধে দিতে পারেন। সেই জায়গায় তাদের গল্পের বই পড়ে শোনান, ছবি আঁকতে দিন। তাতে শিশুর কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পাবে। যখন সে টিভি বা মোবাইলে কিছু দেখে, সেখানে সব দৃশ্য সরাসরি দেওয়া থাকে বলে কল্পনা করার কোনো অবকাশ থাকে না। ফলে কল্পনাশক্তি বৃদ্ধির সুযোগও থাকে না।
শিশুর চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তারা কাজ করতে আগ্রহী। বড়দের কাজ করতে দেখে তার মধ্যেও কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয়। কাজ করার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে বড়দের মতো কর্মক্ষম ও যোগ্য মনে করে আনন্দ পায়। আপনি সব সময়ই তাকে তার নিজের কাজগুলো করতে দিতে পারেন। যেমন—খাট গোছানো, বিছানা পরিষ্কার করা, খেলা শেষে তার খেলনা গোছানো, কাপড় গোছানো। হয়তো সে খুব ভালোভাবে কাজগুলো করতে পারবে না, কিন্তু সে স্বনির্ভর হয়ে গড়ে উঠতে শিখবে। তিন বছরের শিশুর পক্ষেও গোসল শেষে নিজের কাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে বের হওয়া সম্ভব, যদি আপনি চেষ্টা করেন। এই বন্দিদশায় আপনি তাকে তার নিজের কাজ করতে দিয়ে এই শিখন প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে তদারকি এবং সাহায্য করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে শিশুর স্বনির্ভরতা তৈরির পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিষয় ঘটবে—তার আগ্রহ কার্টুন দেখা থেকে অনেকখানি সরে যাবে এবং যারা তার কাজগুলো করে দিতে সাহায্য করে, তাদের প্রতিও সহানুভূতি তৈরি হবে।
শিশুর প্রথম শিক্ষক তার অভিভাবক। আর অভিভাবকরা শৈশবে যে শিক্ষাটি সন্তানকে দেন, তার প্রভাব সারা জীবন সন্তানের ওপর থাকে। সুতরাং করোনার এই দুর্যোগময় গৃহবন্দি অবস্থার ‘সংকট’ ও ‘সুযোগ’—এই দুটিই অভিভাবকদের অনুধাবন করতে হবে। তারপর শিশুর ওপর থাকা মানসিক চাপটি দূর করে সেই জায়গায় আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ