একসময়ে বাংলাদেশের উপকূলে বঙ্গোপসাগর থেকে কোনো ঘূর্ণিঝড় উঠে আসা মানেই ছিল হাজারো মানুষের মৃত্যু; সে পরিস্থিতি এখন বদলেছে। কিন্তু বদলে যাওয়া জলবায়ু নদী বিধৌত এই বদ্বীপে হাজির হয়েছে প্রচণ্ড বজ্রপাত ও বন্যার ক্ষতি।
গত এক দশকে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন ও জরুরি ভিত্তিতে জান-মাল রক্ষার ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়েছে অনেক। আর আইলার পর বাংলাদেশে আসা ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বাতাসের শক্তিও তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
তাতে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমলেও বজ্রপাত ও বন্যার মত দুর্যোগ শঙ্কা বাড়াচ্ছে। চলতি বছর মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর- এই সাত মাসেই বজ্রপাতে মারা গেছেন অন্তত আড়াইশ মানুষ।
ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইন্সটিটিউটের (এনওএএমআই) চেয়ারম্যান ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে স্যাটেলাইটের স্টিল ছবি, অ্যানিমেশনের ভিত্তিতে কাজ করতাম। এখন গাণিতিক মডেল বলে দিচ্ছে, কয়দিন পরে কোন দিকে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, কোথায় আঘাত হানবে।”
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের পর তেমন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে বাংলাদেশকে আর পড়তে হয়নি। বড় যে দু-তিনটি ঝড় হয়েছে, সেগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় একশ থেকে দেড়শ কিলোমিটারের মত ছিল।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার, ১৯৯১ সালে ২২০ কিলোমিটার, ২০০৭ সালের সিডরে ২২৩ কিলোমিটার।
আর ঘূর্ণিঝড় মোরায় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৬ কিলোমিটার, রোয়ানুতে ১২৮ কিলোমিটার, কোমেনে ৬৫ কিলোমিটার ও মহাসেনে ১০০ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র বলেন, দুর্যোগ হিসেবে বজ্রপাতে মৃত্যু হঠাৎ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে মৃত্যু কমতে পারে।
“গ্রামে গ্রামে সচেতনতা বাড়াতে হবে, পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে। বজ্রঝড়ের সময় ব্যাপক সচেতনতা, ‘নাউ কাস্টিং ফোরকাস্ট’, রাডার স্টেশন কার্যকর রাখতে হবে। অন্তত আধ ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস প্রচার করতে হবে।”
সেইভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম নির্বাহী প্রধান আব্দুল আলীম জানান, মার্চ থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত ৬ মাসে বজ্রপাতে ২৩১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে ৬৪ জন।
তিনি জানান, শুধু কৃষি কাজ করতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছে ১৪৬ জনের। নৌকায় থাকা অবস্থায় বা মাছ ধরতে গিয়ে মারা গেছে ৩৩ জন।
সম্প্রতি নৌকায় করে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নদীর ঘাটে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে এক সঙ্গে এত লোকের প্রাণহানি বিশ্বে জানা ইতিহাসে এটাই প্রথম বলে মনে করা হয়।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম জানান, ২০১৮ সাল ছাড়া গত ছয় বছর নিয়মিত বড় বন্যা হয়েছে, যেগুলো ১০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে। গত দুই বছর বেশ ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
বাংলাদেশে দুর্যোগের ঝুঁকির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যা, বজ্রপাত বাড়ছে। কোনো কোনো জায়গায় নগর বন্যা হচ্ছে, অতি বৃষ্টিতে মহানগর ডুবছে রংপুর-চট্টগ্রাম, ভূমিধস ঘটছে। নভেম্বরে দক্ষিণাঞ্চলে পানি স্বল্পতায় খরা পরিস্থিতি হয়েছে; হিটওয়েভ দেখা যাচ্ছে, হিটশক ঘটছে কৃষিতে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে, জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সুন্দরবন হুমকিতে রয়েছে।”
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে মানবসৃষ্ট কারণে এধরনের দুর্যোগের প্রবণতা বাড়ার কথা তুলে ধরে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি, যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় ভরে ফেলা ও বন উজাড় করার মতো বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন সাইফুল।
তিনি বলেন, বন্যার দুর্যোগ প্রশমনে তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হয়, মানুষ, গবাদিপশুকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্যায় বাঁধ পুনর্গঠনে সরকারের অনেক অর্থ খরচ হয়। অনেক জায়গায় বন্যার পর নদী ভাঙ্গন তীব্র হয়। স্থায়ী ক্ষতি প্রতিরোধে অনেকগুলো বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে।
“বন্যার সঙ্গে বসবাসের জন্য বাড়িগুলোকে বন্যাসহনীয় করে তৈরি করা, উুঁচ করে বানানো। পাশাপাশি কৃষি নিয়ে পরিকল্পনা করা, বন্যার ওয়ার্নিং সিস্টেম জোরদার করাসহ বন্যা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জোর দিতে হবে। লবণাক্ততা রোধ ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে উপকূলীয় এলাকায় আলাদা জোর দিতে হবে।”(বিডিনিউজ)
১২ অক্টোবর ২০২১