বাংলাদেশের সাভারে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১১শর বেশি শ্রমিক। আহত হন ২৪শর বেশি।
সাভারের বৈদপাড়া এলাকার বাসিন্দা কাশেম আলী বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনায় পরিবারের তিনজন সদস্যকে হারিয়েছেন।
তিনবছর পর এখন কেমন কাটছে তার পরিবারের দিন?
আমার নাম কাশেম আলী। বড় ছেলের নাম উজ্জ্বল, বয়স ছিল ২৭। ছোট ছেলের নাম আফজাল বয়স ১৮।
আর বড় ছেলের বউ খাদিজা। তার বয়স আনুমানিক ২২ বছর ।
বড় ছেলে সিনিয়র অপারেটর। ছোট ছেলে হেলপার। বউ কোয়ালিটি। ওরা কাজ করতো তিন তলায় নিউ বটম (নিউ বটম ওয়েভ লিমিটেড) কারখানায় ।
একজন বলল যে, “আমি যেসময় বের হয়ে আসছি জানালা দিয়ে লাফ দিলাম। উজ্জ্বল ভাইরে ডাক দিলাম । উজ্জ্বল ভাই আসলো না”।
ওই যে বউ ছিল। বউকে বের করে আনতে গিয়ে আর বের হতে পারে নি।
বৈদ্যপাড়া এলাকায় জীর্ণ ঘরের টিনের দেয়ালে পাশাপাশি দুই ছেলের ছবি। নিহত দুই ভাইর ছোট বোন একটি ছবি নামাতে গিয়ে পড়ে গেলে তড়িৎ বেগে দৌড়ে আসেন তাদের মা। এখন এই স্মৃতিই তার সম্বল।
আর ছোট ছেলে গেটের কাছেই ছিল। সেও দাঁড়িয়ে ছিল । বলে ভাই আসুক একসাথে বের হবো। সেও আসতে পারেনি।
অধরচন্দ্র মাঠে পাঁচ দিনের দিন বড় ছেলের লাশ পেলাম। ছোট ছেলের লাশ তো পেলামই না। খুঁজলাম কত।
চার দিন ধরে তালাশ করে ৫ দিনের দিন সকাল সাতটার গাড়িতে গেলাম। দম মিনিট পরেই বউর লাশ আসলো।
বউর নাম ধরে বলছে “এই লাশের নাম খাদিজা”। দৌড় দিয়ে দলে দলে যাচ্ছে। একজন বলে আমার বোনের লাশ, আরেকজন বলে আমার ভাইয়ের বউর লাশ। আমিও আস্তে আস্তে গিয়ে ভালো করে দেখলাম। দেখি আমার ছেলের বউর লাশ।
ডোম ছেলেটাকে বললাম, আমার কাছে ছবি ছিল। আইডি কার্ডের সাথে একদিকে ছেলের ছবি আরেক দিকে তার বউয়ের ছবি ছিল।
তা ও জোর করে অন্যরা নিয়ে নিতে চায় । পরে কি করবো? পুলিশকে গিয়ে খবর দিলাম। এরপর আস্তে করে তারা সরে গেল।
একটু পরেই বললো একজন পুরুষের লাশ আসলো। দৌড়ে গেলাম। সেখানে তিন-চারজন দাবিদার।
একজন বলে আমার ভাইর লাশ, একজন বলে আমার ভাতিজার লাশ। একেকজন একেক কথা বলে।
কিন্তু আমি ভাল করে দেখে বললাম, আমার ছেলের লাশ। ডোম ছেলেটা বলল, কাকা চিনলেন কি করে?
আমার ছেলের তো কোথাও একটু কাটেনি, ফাটেনি, কিছু হয়নি।
টাকা ছিল ২০ হাজার পকেটে। ডোম ছেলেটা জিজ্ঞেস করে “কাকা আপনার ছেলের কি কোন ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছিল না”?
আমি বললাম, ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল কি ছিল না তা আমরা বলতে পারবো না। তবে এক সপ্তাহ আগে জানতে চেয়েছিল, “আব্বা ২০/২২ হাজার টাকা হলে কি একটা গরু কেনা যাবে নাকি? গরু যখন আছে কয়েকটা আর একটা বাছুর কিনে কোরবানির সামনে বিক্রি করা যাবে”।
রানা প্লাজা ধসের পর অনেকেরই পরিবার তাদের স্বজনের মৃতদেহ পায়নি।
আমি বললাম হবে। তা সেই টাকা কোথায় রেখে গেছে এখনো সে খবর পাইনি। এরপর আইডি কার্ড দেখালাম মিলে গেল।
পরে ডোম বলল, ‘পুলিশের কাছে আপনার ছেলের টাকা জমা আছে, নিয়ে নিয়েন।
সারা বিশ্বে শুনিনি বিল্ডিং এভাবে ভাঙ্গে। বিল্ডিং ভাঙলে কাত হয়ে থাকবে, ঝুলে থাকবে, রড সিমেন্টের বিল্ডিং তো। ঝপাৎ করে পড়ে দসে যাবে এটা তো বিল্ডিং এর কাজ না।
ক্ষতিপূরণ দিয়েছে তবে ষোলো আনা দেয়নাই। তালবাহানা করছে। দুই ছেলে তো। কিন্তু একটা অ্যাকাউন্ট করছি। পঞ্চাশ লাখের মত পাইছি, সেটা ব্যাংকে রেখে টুকটাক করে যা আসে তা দিয়ে চলি।
এখন আমার উপার্জনের কেউ নেই। দুই মেয়ে। বড় মেয়ের জামাইটা ভাল না। মেয়েকে নেয় না। বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। আর ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।
বড় মেয়ে আর মুসলিমে চাকরি করে। নিষেধ করি। চিন্তা হয়। কখন কি ঘটে। মেয়ে বলে ‘নাতিটা আছে, তার পড়ালেখার খরচ লাগে। তুমি একলা কি করবা?’
আমার স্ত্রী তার দুই সন্তানকে হারিয়ে এখন খুবই মেজাজ খারাপ থাকে। কারও সামান্য একটু কিছু হলেই সে অস্থির হয়ে যায়। অনেকটা যেন পাগলের মত চিৎকার করে ওঠে।
বিবিসি সূত্রে নিউজ ডেস্ক : আপডেট ৭:২০ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ