চাঁদপুর টাইমস ডট কম :
ভট্টপুর খালপাড়ে পা দিতেই কানে এসে লাগলো দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। ঠিক কোন ভাষার গান বোঝা গেল না, ওই দড়াম দড়াম সাঙ্গীতিক অত্যাচারটাই সার!
কয়েক পা এগোতেই খাতায় টুকে আনা নামগুলো একে একে মিলে যাচ্ছে। হাতের ডানে ভট্টপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বামে দ্বিশতবর্ষী বটবৃক্ষ। মাঝখানে একচিলতে মাঠ। মাঠময় উদ্ভ্রান্ত শিশু-কিশোরদের ছোটাছুটি। একপাশে শূন্য মঞ্চ, সামনে সারি সারি খালি চেয়ার পাতা। দেখে লাগে, বাপে খেদানো ছেলে-ছোকড়াদের কোনো ক্লাব ফাংশন!
খটকা লাগলো! ঠিকানা মিলছে কিন্তু আসল ব্যাপারের তো দেখাই নেই। তবে যে শুনেছিলাম, একশ বছরেরও বেশি পুরোনো মেলা। বটগাছের নিচে ফুল-ফলের ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে নববধূ আর তরুণীরা। কারও শ্বেতপায়রা হাতে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদনের অপেক্ষা। চারদিকে দই, ক্ষীর, পায়েসের নেশা ধরানো সুগন্ধ। একে একে বটগাছের গোড়ায় সংসারের সুখ, সমৃদ্ধি আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য হাজারো মানত।
আরও বললে, মৃৎশিল্পীদের তৈরি নানা রঙের পুতুল, হাতি, ঘোড়া, ময়না, টিয়া, বাঘ-ভালুক, হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে মণ্ডা-মিঠাই, অমৃতি, আর জিলাপির দোকান। কিন্তু কই সেসব!
ভ্রু কুঁচকে যখন জোড়া লেগে যাবার দশা, তখন উদ্ধার করলেন, ষাটোর্ধ্ব বীরেন পাল।
জানালেন, এটি মূলত সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজো। সনাতন ধর্মালম্বীরা প্রাচীন এ বটবৃক্ষকে সিদ্ধেশ্বরী দেবী বলে মানেন। সেখান থেকেই মেলার উৎপত্তি। নারীদের নিয়ে পূজো, তাই নাম হয়ে গেছে বউমেলা। প্রতিবছর বৈশাখের প্রথম দিন হলেও এবার পঞ্জিকা অনুযায়ী পূজো হবে বৈশাখের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ, বুধবার (১৫ এপ্রিল)। পূজোর পর থেকেই জমে ওঠে আসল মেলা।
অগত্যা! যাই হোক, এসেই যখন পড়েছি তখন কী আর করা। আর হ্যাঁ, ভৌগলিক অবস্থানে এই এসে পড়াটা বাংলার আদি রাজধানী সোনারগাঁয়ে। আরও খুঁটিয়ে বললে, জয়রামপুর গ্রাম। স্থানীয়দের ভাষ্যে, বটতলা বা বউতলা। উদ্ভবগঞ্জ বাজার হয়ে বাঁ দিকের গলিপথ ধরে যাওয়া যাবে একবারে বটগাছের গোড়ায়।
আর গাছের গোড়াতেই দেবীর উদ্দেশ্যে রাখা হয় নৈবেদ্যসহ নানা নিবেদন। গেল বছরের সাংসারিক যত ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য দূর হয়ে সুখ-শান্তি আর মধুরতায় যেন নতুন বছর শুরু হয়, এই কামনা থেকেই মূলত এই পূজো, যোগ করেন বীরেন দাদু।
বৈশাখের প্রথম দিবসে প্রাক-বউমেলার মান কিছুটা রাখলো খালপাড়ের কোনার দিকে বসা একমাত্র নাগরদোলা। বাপ-দাদার ব্যবসার উত্তর প্রজন্ম হিসেবে মেলায় নাগরদোলা খাটিয়েছেন স্থানীয় আমছালি গ্রামের মিলন (২৯)।
বউমেলা নিয়ে তার গলাতেও একই সুর, আজ বিকেলের দিকে একটু ভিড়-ভাট্টা হলেও, পূজোর সকাল থেকেই মানুষের আনাগোনা বাড়ে। এসময় ব্যবসাপাতিও ভালো হয়। মেলার সাতদিনই আমি এখানে নাগরদোলা নিয়ে থাকবো।
বটগাছের একটু সামনেই লেইসফিতা নিয়ে বসেছেন ৪৬ বছর বয়সী মো. মিন্টু। নিয়ে বসা বললে একটু ভুলই হবে। কারণ, তিনি এখনও বাক্স-পেটারাই খোলেননি।
কী অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বললেন, খুলবো আর কী আস্তে-ধীরে। আমার কাস্টমাররা সব আসবে কাল থেকে।
আর বলতে গেলে মণ্ডা-মিঠাইয়ের খবর। তাও যেগুলো রয়েছে, ঝাঁপ নামানো অবস্থা। দু-একটা যাও খোলা, তারা ‘মিষ্টান্ন প্রস্তুতকরণ’ পর্যায়ে।
মাঝখানে মিহিদানার বড় গামলা, সেটি ঘিরে গোল হয়ে বসেছেন মো. মহিউদ্দিন (৫২), মতিউর (৩৭) আর শাহ হালিম (৩০)। সকাল থেকেই নিপুণ হাতে বানিয়ে চলেছেন সুস্বাদু লাড্ডু।
এছাড়া সাতদিনব্যাপী এ মেলায় ভোজনরসিকদের জিভে জল আনার জন্য দানাদার, বালুসা, জিলাপি, কয়েকরকম গজা, মিষ্টি তো থাকছেই!
এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেটাই মনে হলো। নারীকেন্দ্রিক মেলা তাই তাদের সাজু-গুজুর জিনিসের দোকানই বেশি। মানে ওই আর কী, এখন পর্যন্ত যা বসেছে। তবে দোকানের সামনে যা ভিড়, তাদের মধ্যে অক্রেতাই বেশি!
সূত্র- চাঁদপুর টাইমস/ডিএইচ/২০১৫