একসময় লোহিত সাগর দিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১০ % পণ্য চলাচল করত। প্রায় এক বছরের ব্যবধানে তা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এ বাণিজ্য পথে গত বছরের নভেম্বরে আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয় হুথি যোদ্ধারা। এর পরই রুটটির ব্যবহার কমতে শুরু করে, যা সময় ও খরচের হিসাবে বড় আকারে প্রভাবিত করছে সরবরাহ চেইনকে। খবর আনাদোলু এজেন্সি।
মূলত গাজায় ইসরায়েলি হামলার জেরে লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করে হুথিরা। তারা বলে আসছিল,ফিলিস্তিনিদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই লোহিত সাগর ও বাব এল-মানদেব প্রণালিতে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্যিক জাহাজকে আক্রমণ করছে। ডিসেম্বর নাগাদ আক্রমণের তীব্রতা বাড়ে। এরপর থেকে প্রায় এক বছর ধরে বাব এল-মানদেব প্রণালি ও সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী বেশির ভাগ বাণিজ্যিক জাহাজ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে চলাচল করছে।
শিপিংসংশ্লিষ্ট মেরিনট্রাফিকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লোহিত সাগর হয়ে জাহাজ চলাচল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৬ % কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে কনটেইনার জাহাজ চলাচল, গত এক বছরে চলাচল কমেছে ৭৩ % । এছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বহনকারী জাহাজ ৮৭, ড্রাই বাল্ক ৫৪ ও মিক্সড বাল্ক চলাচল ৩৭ % কমে গেছে। এছাড়া তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) জাহাজ ৭৪, রোল-অন/রোল-অফ জাহাজ ৭৮ ও ওয়েট বাল্ক চলাচল ৪১ % কমে গেছে।
অন্যদিকে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে জাহাজ চলাচল এক বছরে ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। এ রুটে কনটেইনার জাহাজ পারাপার বেড়েছে ৪২০ শতাংশ। মিক্সড বাল্ক ১৫৭, ড্রাই বাল্ক ৩৮ ও এলএনজি জাহাজ চলাচল ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া এলপিজি জাহাজ চলাচল ১৩৮, রোল-অন/রোল-অফ জাহাজ ৩৫০ ও ওয়েট বাল্ক জাহাজের সংখ্যা ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে জাহাজের ১০-১২ দিন বেশি সময় লাগে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে লোহিত সাগর এড়ানোর হার বেড়েছে দ্রুত। সময়ের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত খরচ বাড়ায় সামগ্রিক খরচও সমানতালে বেড়েছে। ড্রিউরির ওয়ার্ল্ড কনটেইনার ইনডেক্স (ডব্লিউসিআই) অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে পরিবহন খরচ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সাত মাসের ব্যবধানে এ সূচক ২৬৮ শতাংশ বেড়ে ৪০ ফুট কনটেইনারপ্রতি ৬ হাজার ডলারে পৌঁছায়। তবে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ ডেলিভারি সময়সূচি সমন্বয়ের ফলে এ হার কিছুটা কমে যায়।
গত সপ্তাহে ৪০ ফুট কনটেইনারের ভাড়া ছিল ৩ হাজার ৪৮৯ ডলার, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ১১৬ শতাংশ এবং কভিড-পূর্ব গড়ের তুলনায় ১৪৬ শতাংশ বেশি।
লোহিত সাগরের এ ঘটনা সামুদ্রিক বাণিজ্যের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে বলে জানান জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার বাণিজ্য লজিস্টিকস বিভাগের প্রধান জ্যান হফম্যান। কেননা সমুদ্রপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৮০ % সংঘটিত হয়।
এখন পণ্যবাহী জাহাজ সুয়েজ খালের সংক্ষিপ্ত পথ এড়িয়ে উত্তমাশা অন্তরীপের রুট ধরছে, যা যাত্রাপথ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। জ্যান হফম্যান বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের রাস তানুরা বন্দর থেকে নেদারল্যান্ডসের রটারডামে যাওয়া একটি জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকারকে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৪ শতাংশ বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হচ্ছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর থেকে একই বন্দরে পাঠানো কনটেইনার ৪২ শতাংশ বেশি পথ পাড়ি দিচ্ছে।’
কিছু দেশের সামুদ্রিক ও বৈদেশিক বাণিজ্য সুয়েজ খালের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা সুদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশটির বাণিজ্যের ৩৪ শতাংশ সুয়েজ খালের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। জিবুতির ক্ষেত্রে এ হার ৩১ % , কেনিয়ার ১৫ ও তানজানিয়ার জন্য ১০ % । তুলনামূলক জার্মানির বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বেশি হলেও মাত্র ৭ % সুয়েজ খালের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।’
সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ভর্টেক্সার প্রধান ফ্রেইট বিশ্লেষক ইয়োয়ানিস পাপাডিমিত্রিউর মতে,গাজায় ইসরায়েলি হামলা ও হুথিদের পাল্টাহামলা ট্যাংকার বাজারে প্রভাব ফেলেছে। ফলে বাণিজ্য প্রবাহের উৎস বা গন্তব্যে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে ট্যাংকারে যাত্রাপথ দীর্ঘায়িত হয়েছে।
পাপাডিমিত্রিউ বলেন,‘ট্যাংকার অপারেটররা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কায় সুয়েজ খালের পরিবর্তে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক বেসিন পর্যন্ত দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক উপকরণ ও জনবলের চাহিদা এবং ট্যাংকার পরিবহনের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।’
চলতি বছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে ডিজেল বহনকারী ট্যাংকারের ভাড়া গত বছরের তুলনায় গড়ে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। পাপাডিমিত্রিউ বলেন, ‘হামলা শুরুর পর থেকে ট্যাংকার অপারেটররা ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘপথ বেছে নিয়েছে। ফলে সুয়েজ খাল দিয়ে ট্যাংকার চলাচল ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। যুদ্ধবিরতি বা চলতি উত্তেজনা কমে গেলে ধীরে ধীরে বাণিজ্য রুটের দূরত্ব কমতে পারে।
চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
৯ অক্টোবর ২০২৪
এজি